আফ্রিকা মহাদেশের জলবায়ুর বৈচিত্র্যের কারণ লেখ।
1. অক্ষরেখা:
আফ্রিকা মহাদেশ 37° উত্তর অক্ষাংশ থেকে 35° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এই মহাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলই গ্ৰীষ্ম প্রধান উষ্ণমণ্ডলের মধ্যে পড়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের উপর দিয়ে নিরক্ষরেখা চলে যাওয়ায় প্রায় সারাবছর এই মহাদেশে লম্বভাবে সূর্যকিরণ পড়ে। এর ফলে, এই মহাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই উষ্ণ তাপমাত্রা বিরাজ করে।
অন্য দিকে নিরক্ষরেখা থেকে যত মেরুর দিকে যাওয়া যায় সূর্যের তির্যক রশ্মির কারণে উষ্ণতা তত কমে যায়।
2. সমুদ্র থেকে দূরত্ব:
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্বে লোহিত সাগর, পূর্বে ভারত মহাসাগর, উত্তরে ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর এই মহাদেশকে ঘিরে থাকায় নিকটবর্তী সমুদ্রের প্রভাবে এই মহাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে সমভাবাপন্ন জলবায়ু দেখা যায়।
কিন্তু এই মহাদেশের উঁচু মালভূমি অঞ্চল এবং সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত অঞ্চলে সমুদ্রের প্রভাব ততটা পড়ে না বলে এইসব অঞ্চলে চরমভাবাপন্ন জলবায়ু বিরাজ করে। অর্থাৎ এখানে ঠান্ডা ও গরমের পার্থক্য খুব বেশি হয়।
3. সমুদ্রস্রোত:
সমুদ্রের মধ্যে যে বিপুল জলরাশি স্রোতের মতো বয়ে চলে তাকে সমুদ্রস্রোত বলে। সমুদ্রস্রোত মূলত দুই ধরনের হয়। যথা – উষ্ণ সমুদ্রস্রোত ও শীতল সমুদ্রস্রোত। এই দুই রকম স্রোত উপকূল বরাবর প্রবাহিত হয়ে সেই জায়গার জলবায়ু নির্ধারণ করে।
4. ভূমির উচ্চতা:
সাধারণভাবে আফ্রিকা মহাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে সারাবছর ধরে উষ্ণ থাকলেও, বেশি উচ্চতার জন্য এই মহাদেশের উঁচু মালভূমি অঞ্চলগুলি তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম উষ্ণতা যুক্ত হয়। প্রতি 1 কিমি উচ্চতা বাড়লে বাতাসের উষ্ণতা গড়ে 6.4° সেলসিয়াস হারে কমে।
Read- আফ্রিকা মহাদেশ সম্বন্ধীয় কিছু প্রশ্ন।
জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের তারতম্য অনুসারে আফ্রিকা মহাদেশকে কটি জলবায়ু অঞ্চলে ভাগ করা যায় ও কি কি?
জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের তারতম্য অনুসারে আফ্রিকা মহাদেশকে আটটি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা –
- নিরক্ষীয় অঞ্চল
- উষ্ণ তৃণভূমি সাভানা অঞ্চল
- উষ্ণ মরুভূমি অঞ্চল
- ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল
- নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি বা ভেল্ড অঞ্চল
- শীতল উচ্চভূমি অঞ্চল
- মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চল
- চীনদেশীয় জলবায়ু অঞ্চল
জলবায়ুর সঙ্গে স্বাভাবিক উদ্ভিদের সম্পর্ক লেখ।
আফ্রিকা মহাদেশের জলবায়ু সবজায়গায় সমান নয়। বিশেষ করে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর গাছপালার প্রকৃতি নির্ভর করে। আফ্রিকা মহাদেশে স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রকারভেদ নিম্নে আলোচনা করা হল –
1. নিরক্ষীয় চিরসবুজ গাছের অরণ্য:
নিরক্ষরেখার কাছাকাছি অঞ্চলে সারাবছর গরম বিরাজ করে, প্রায় 27°C এর কাছাকাছি উষ্ণতা থাকে। মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকে প্রায় 200 থেকে 250 সেমি। সারাবছর সরাসরি সূর্যকিরণ ও বৃষ্টিপাতের কারণে শক্ত কাঠের ঘন জঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে। গাছগুলি থেকে সারাবছর সেভাবে পাতা না ঝড়ায় গাছগুলি সারাবছর সবুজ দেখায়। তাই এই অরণ্য চিরসবুজ অরণ্য নামে পরিচিত।
মেহগনি, রোজউড, এবনি প্রভৃতি এই জঙ্গলের প্রধান গাছ।
2. সাভানা তৃণভূমি:
নিরক্ষীয় অঞ্চলের উত্তরে ও দক্ষিণে বৃষ্টি কম হয়। বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় 150 সেমি। মরুভূমির দিকে এই পরিমাণ কমে 25 সেমি হয়। মোটামুটি গরম ও তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাতের জন্য এখানে বেশি উচ্চতার গাছ জন্মায় না, তার বদলে বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে লম্বা ঘাস জন্মায়। একে সাভানা তৃণভূমি বলে।
দিগন্ত বিস্তৃত ঘাসজমির মধ্যে অ্যাকসিয়া ও বাওবাব জাতীয় গাছ দেখা যায়।
3. ভূমধ্যসাগরীয় উদ্ভিদ:
আফ্রিকার একেবারে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু দেখা যায়। এই জলবায়ু অঞ্চলে গ্ৰীষ্ণকালে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে এবং শীতকালে গড়ে প্রায় 50 থেকে 100 সেমির কাছাকাছি বৃষ্টিপাত হয়। পাতা পুরু হয় এবং পাতার উপরে মোমের নরম স্তর চোখে পড়ে। গরমকালে জলের খোঁজে এখানকার উদ্ভিদ গুলির মূল মাটির ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
জলপাই, ওক, আখরোট, ডুমুর, কর্ক প্রভৃতি গাছ এখানে জন্মায়। এছাড়া কমলালেবু, আঙ্গুর প্রভৃতি ফলের গাছও জন্মায়।
4. উষ্ণমরু উদ্ভিদ:
সাহারা, নামিব, কালাহারি মরুভূমি অঞ্চলগুলিতে সারাবছর বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। এখানে দিনে ও রাতের মধ্যে উষ্ণতার পার্থক্য বিস্তর। এখানকার গাছগুলি নিজেদের শরীরে জল ধরে রাখতে পারে। তাই অতিরিক্ত গরমেও গাছগুলি বেঁচে থাকে।
এখানে মূলত কাঁটা জাতীয় গাছ, ঝোপঝাড়, ঘাস ইত্যাদি গাছ জন্মায়। এছাড়া মরুভূমির মাঝে যে মরুদ্যান থাকে তার চারপাশে তাল, খেজুর জাতীয় গাছ জন্মায়।
5. নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি বা ভেল্ড:
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ দিকে কালাহারি মরুভূমি আর ভারত মহাসাগরের ধারে উপকূল অঞ্চলে শীতকালে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। এখানে শীত গ্ৰীষ্মের তাপমাত্রার পার্থক্য খুব বেশি। এই তৃণভূমিকে ভেল্ড বলে।
উচুঁ পাহাড়ের ঢালে পপলার, উইলো প্রভৃতি গাছ জন্মায় এবং সমভূমি অঞ্চলে ছোটো, খসখসে ঘাস জন্মায়।
6. মৌসুমী পর্ণমোচী গাছের অরণ্য:
আফ্রিকার একেবারে পূর্বদিকে আর মাদাগাস্কার দ্বীপে গরমকালে বৃষ্টি হয় এবং শীতকালে শুষ্ক থাকে। এখানে কোনো ঋতুতেই তাপমাত্রা খুব বেশি হয়। এখানে শীতকালে জলের অভাবে গাছের পাতা ঝড়ে যায়।
এখানে শাল ও বাঁশ গাছের জঙ্গল দেখা যায়।
7. পূর্ব উপকূলীয় উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ বা চিনদেশীয় উদ্ভিদ:
দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল অঞ্চলে গরমকালে বেশ গরম ও বৃষ্টিপাত হয়। চিন দেশের পূর্বাংশে এই রকম জলবায়ু দেখা যায় বলে একে চিনদেশীয় জলবায়ু বলে।
এখানে পাতাঝরা গাছ বেশি দেখা যায়। এছাড়া ওক গাছও জন্মায়।
Read- মধ্য ও নিম্নগতিতে নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ গুলির বর্ণনা দাও।
This post was updated on 2023-02-22 17:58:17.