আলফ্রেড ওয়েবারের শিল্প স্থানিকতার নূন্যতম ব্যয় তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।

 ওয়েবারের শিল্প স্থানিকতার নূন্যতম ব্যয় তত্ত্ব সম্পর্কে এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এখান থেকে পুরো ত্রত্ত্ব টি 7 মার্কসের জন্য আবার কখনো কখনো ছোট ছোট পার্ট করেও 2 মার্কস বা 3 মার্কস বা 5 মার্কস এও পরীক্ষায় দেয়। সুতরাং প্রশ্নটি মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।

ভূমিকা:

প্রখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড ওয়েবার 1909 সালে কোনো শিল্প বা উৎপাদন কেন্দ্রের আদর্শ অবস্থান নির্বাচন সম্বন্ধে সর্বপ্রথম একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন। তাঁর মতবাদটি ‘নূন্যতম ব্যয় অবস্থান তত্ত্ব’ নামে পরিচিত।

উদ্দেশ্য:

  1. একটি শিল্পের সর্বনিম্ন ব্যয়জনিত অবস্থান নিশ্চিত করা।
  2. শিল্পের অবস্থান নির্বাচনে পরিবহন ব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্থাপন করা।
  3. পরিবহন ব্যয় এর উপর যে শিল্পের অবস্থান নির্ভর করে তা প্রমাণ করা।

অনুমান সমূহ:

    1. শিল্প যেখানে গড়ে উঠবে,সেই সম্ভাব্য অঞ্চলটি সর্বার্থে এক ও অভিন্ন। এখানে ভূপ্রকৃতিতে কোনো বৈচিত্র্য নেই, জলবায়ু সমান, জনসাধারণ একই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

    2. শিল্পের প্রয়োজনীয় প্রকৃতিদত্ত কাঁচামাল মূলত দুই ধরনের, যেমন-

  • সর্বত্র প্রাপ্তিযোগ্য সামগ্রী(যেমন- জল, বাতাস)।
  • ভৌগোলিক ভাবে অনড় ও কেন্দ্রীভূত সামগ্রী (যেমন- কয়লা, আকরিক লোহা ইত্যাদি)।

    3.শ্রমিকের উৎস, জোগান ও মজুরি নির্দিষ্ট। 

    4.পরিবহন ব্যয় পরিবাহিত দ্রব্যের ওজন ও পরিবহন পথের দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে।

     5.উৎপাদিত দ্রব্যের একচেটিয়া বাজারের পরিবর্তে যথার্থ প্রতিযোগিতা মূলক বাজার থাকবে।

    6. উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা ও দাম সর্বত্র একই থাকবে।

মূল ধারণা:

ওয়েবারের মতে,যখন কোন অঞ্চলে উপরিউক্ত অবস্থা গুলি থাকে তখন শিল্প স্থাপনের পক্ষে সর্বাপেক্ষা অনুকূল জায়গা হল-
 A. যেখানে পরিবহন ব্যয় ন্যূনতম ।
 B. যেখানে শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে কম।
 C. সাহায্যকারী অন্যান্য শিল্পের একত্রে সমাবেশ।

A. শিল্প অবস্থানে পরিবহন ব্যবস্থার ভূমিকা:

                                ওয়েবারের মতে শিল্পে দু ধরনের পরিবহন ব্যয় হয়।

  • কাঁচামাল আনার ব্যয় এবং
  •  উৎপাদিত দ্রব্য পণ্য বাজারে পাঠানোর ব্যয় 

তাঁর মতে কোন শিল্প কাঁচামালের উৎস স্থলে গড়ে উঠবে না বাজারে স্থাপিত হবে তা নির্ভর করে দ্রব্যসূচক বা পণ্য সূচক বা Material Index এর উপর।
            

পণ্যসূচক=শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওজন/শিল্পে উৎপন্ন দ্রব্যের ওজন

ওয়েবারের মতে ,যদি দ্রব্য সূচকের মান 1 এর অধিক হয় তাহলে কারখানা কাঁচামাল উৎসের নিকটে (অবিশুদ্ধ কাঁচামাল) এবং দ্রব্য সূচক 1 হলে (বিশুদ্ধ কাঁচামাল যেমন কার্পাস) শিল্প স্থাপনের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যেখানে বেশি সেখানে গড়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যায়।
                 শিল্পের অবস্থানের উপর পরিবহন ব্যয়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে ওয়েবার তার তত্ত্বে দুটি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে একাধিক সম্ভাবনার কথা আলোচনা করেছেন।

1. একটি বাজার ও একটি কাঁচামাল:

  •    কাঁচামাল টি সর্বত্র প্রাপ্ত হলে শিল্পটি বাজারের নিকট গড়ে উঠবে।
  • কাঁচামালটি বিশুদ্ধ হলে ও কেন্দ্রীভূত হলে শিল্পটি উৎপাদক অঞ্চলে বা বাজারে বা উভয়ের মধ্যবর্তী যে কোন অঞ্চলে গড়ে উঠবে।
  • কাঁচামালটি কেন্দ্রীভূত ও অবিশুদ্ধ হলে শিল্পটি কাঁচামাল উৎসের কাছে গড়ে উঠবে।

2. একটি বাজার ও দুটি কাঁচামাল:

  • যখন কোন শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল দুটি সর্বত্র প্রাপ্ত হয় তখন শিল্পটি বাজারে গড়ে উঠবে।
  •  একটি সর্বোচ্চ প্রাপ্ত কাঁচামাল ও অন্যটি বিশুদ্ধ হলে শিল্পটি বাজারের নিকট গড়ে উঠবে।
  •  একটি কাঁচামাল সর্বোচ্চ প্রাপ্ত এবং অন্যটি অবিশুদ্ধ ও কেন্দ্রীভূত শ্রেণীর হলে কাঁচামাল উৎসের কাছেই শিল্পটি গড়ে উঠবে।
  • একটি বিশুদ্ধ ও একটি অবিশুদ্ধ শ্রেণীর কাঁচামাল হলে শিল্পেটি কাঁচামাল উৎপাদক কেন্দ্রের কাছেই গড়ে উঠবে।
  •  উভয় কাঁচামাল কেন্দ্রীভূত ও অবিশুদ্ধ শ্রেণীর হলে 
  • শিল্পের অবস্থানের বিষয়টি কিছুটা জটিল হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কাঁচামাল দুটির সমদূরবর্তী ও নূন্যতম পরিবহন ব্যয় যুক্ত স্থানে শিল্প টি গড়ে উঠবে।এই বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ওয়েবার তার তত্ত্বে বিখ্যাত ‘ স্থানিকতা ত্রিভুজ’ ধারণার অবতারণা করেছেন।ধরা যাক,একটি ত্রিভুজের তিনটি অংশের দুটিতে কাঁচামালের উৎস ও একটি বাজার অবস্থান করছে এরূপ অবস্থায় পরিবহন ব্যয় জনিত বল যেমন ভাবে কাজ করে শিল্প কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে যদি তিন দিকের বল সমান হয় তাহলে কারখানাটি ত্রিভুজের মধ্যস্থলে গড়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যায়।

✓আইসো টিম:

              আইসোটিম কথার অর্থ হলো ‘সমপরিবহন ব্যয় রেখা’। ওয়েবারের মতে শিল্পে দুই ভাবে পরিবহন ব্যয় হয়- শিল্প কেন্দ্রের কাঁচামাল আনা ও বাজারে শিল্পজাত সামগ্রী পাঠানো। এই দুই ধরনের পরিবহন ব্যয় আলাদাভাবে বোঝানোর জন্য ওয়েবার যে কাল্পনিক বৃত্তাকার রেখা কল্পনা করেছেন তাকে আইসোটিম বলে।

✓আইসোডোপেন:

                      ন্যূনতম পরিবহন ব্যয় নির্ণয় করার জন্য অধ্যাপক ওয়েবার কাঁচামালের আইসোটিম ও উৎপাদিত পণ্যের আইসোটিম যখন পরস্পর ছেদ করে, সেই ছেদবিন্দুকে যুক্ত করে আর এক প্রকার ডিম্বাকৃতি রেখা কল্পনা করেছেন।এই রেখাকে বলে মোট পরিবহন ব্যয় রেখা বা আইসোডাপেন। ওয়েবারের মতে, যে জায়গায় আইসোডোপেন এর মান সবচেয়ে কম সেই জায়গাটি শিল্প গড়ে তোলার পক্ষে আদর্শ।

B. শিল্পের অবস্থানের ওপর মজুরি ব্যয়ের প্রভাব:

ওয়েদার তার শিল্প স্থানিকতা নুন্যতম ব্যয় তত্ত্বের পরিবহন ব্যয়ের প্রভাব ছাড়াও মজুরি বাবদ ব্যয় সংকোচ এর গুরুত্ব আলোচনা করেছেন। তার মতে ন্যূনতম পরিবহন ব্যয় সাপেক্ষে সাপেক্ষে নির্ধারিত কোন একটি স্থান থেকে যেখানে শ্রমিক সহজলভ্য শিল্পটি সেখানে যেতে পারে। এই গজের তিনি যে তিনটি গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্য নেন সেগুলি হল- 

  1. মজুরী সূচক ।
  2. শ্রম গুনক ।
  3. ক্রিটিকাল আইসোডাপেন।

1. মজুরী সূচক:

          একক প্রতি উৎপাদনের জন্য গড় মজুরিকে মজুরি সূচক বলে। ওয়েবারের মতে শিল্পের মজুরি সূচক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের নূন্যতম পরিবহন ব্যয় অবস্থান থেকে নূন্যতম মজুরি অবস্থানের দিকে সরে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়তে থাকে।

2. শ্রম গুণক:

   কোনো উৎপাদিত সামগ্রীর একক ওজন প্রতি মজুরি ও যে পরিমাণ কাঁচামাল এবং উৎপাদিত দ্রব্য কোনো শিল্পে পরিবহন করার প্রয়োজন হয়, তার সম্মিলিত ওজনের অনুপাতে শ্রম গুণক বলে।ওয়েবারের মতে, যে স্থানে শ্রম গুণক যত কম সেখানে শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও তত বেশি।

3. ক্রিটিক্যাল আইসোডাপেন:

নূন্যতম শ্রমিকের মজুরি ব্যয় ও মোট পরিবহন ব্যয় নির্দেশক কাল্পনিক রেখার নাম ক্রিটিক্যাল আইসোডাপেন। আমরা জানি, ওয়েবারের মতে “আইসোডাপেন” হল এক ধরনের কাল্পনিক রেখা, যে রেখা বরাবর কাঁচামাল ও উৎপাদিত দ্রব্যের মোট 
পরিবহন ব্যয় সমান।এই ভিত্তিতে ক্রিটিক্যাল আইসোডাপেন হল সেই বিশেষ আইসোডাপেন, যে রেখা বরাবর সস্তা শ্রমিকের মজুরিবাবদ ব্যয় লাঘবের পরিমাণ ও কাঁচামাল এবং উৎপাদিত দ্রব্যের মোট পরিবহন ব্যয় সমান। এই রেখা বরাবর শিল্প স্থাপন করা সর্বাপেক্ষা লাভজনক।

C. শিল্প সমাবেশ বা বিকেন্দ্রীভবনের ভূমিকা:

                     ওয়েবারের মতে শিল্পে অনুকূল অবস্থানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ন্যূনতম পরিবহন ব্যয় বা ন্যূনতম মজুরি ব্যায় প্রভাব বিস্তার করে না।কোন একটি স্থানে বিভিন্ন ধরনের শিল্পের সমাবেশ ঘটলে সেখানে শিল্প প্রযুক্তি, সহযোগী শিল্পের বিকাশ, শিল্পের পরিকাঠামোগত সুবিধা ইত্যাদি বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়া যায়।এর ফলে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম হয় এবং নতুন নতুন শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে যদি দেখা যায় মোট পরিবহন ব্যয় বা শ্রমিকের সস্তা মজুরি বাবদ লাভের  তুলনায় শিল্প সমাবেশ এর কারণে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম হয়। সে ক্ষেত্রে নতুন শিল্প ওই একত্রিত শিল্প সমাবেশের মধ্যে গড়ে ওঠার চেষ্টা করবে।

সমালোচনা:

  1. আলোচ্য তত্ত্বটি যে কয়েকটি প্রাথমিক অনুমানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে,সেই পূর্বধারণাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নয়।
  2. ওয়েবারের মতে বাজার হবে পূর্ণ প্রতিযোগিতা মূলক। কিন্তু শিল্প উন্নতির সাথে সাথে পূর্ণ প্রতিযোগিতা রং প্রকৃতিও যথেষ্ট পাল্টে যায়।
  3. আলোচ্য তত্ত্বে ‘ব্রেক অফ বাল্ক’ অবস্থানগুলির প্রভাব সম্বন্ধে কোনো মূল্যায়ন স্থান পায়নি।
  4. ওয়েবারের শিল্প ভাবনায় মূল্যমানের হ্রাস বৃদ্ধির প্রভাব স্থান পায়নি।


Leave a Comment

error: Content is protected !!