ভূমিকা:
ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ধারণা অনুসারে প্রতিটি ভূমিভাগের ক্ষয় একটি ধারাবাহিক ও স্বভাবিক প্রক্রিয়া। উত্থানের পর থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভূমিভাগটি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতায় পৌঁছায়, ততক্ষন ক্ষয়কার্য চলতেই থাকে। যেকোনো ভূমিভাগ ক্ষয়চক্রের কোন পর্যায়ে আছে তা বোঝার জন্য ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য অনুসারে একটি পূর্ণক্ষয়চক্রকে তিনটি অবস্থা বা পর্যায়ে ভাগ করা হয়।
A. যৌবন অবস্থা:
সহজাত বন্ধুরতা নিয়েই একটি ভূমিভাগ সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়। সেই উত্থান পর্ব শেষ হওয়ার পরেই শুরু ভূমিভাগটির যৌবন অবস্থা এবং তখন নদীর দ্বারা ক্ষয়কার্য শুরু হয়ে যায়। এরফলে ভূমিরূপের কতগুলি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল –
1. অনুগামী নদীর সৃষ্টি:
সদ্য উত্থিত ভূমিভাগটি প্রাথমিক ঢাল অনুযায়ী প্রথমে কয়েকটি নদীর সৃষ্টি হয় এদের অনুগামী নদী বলে। এই অনুগামী নদীগুলির আবার ছোটো ছোটো উপনদী থাকে। উপনদীগুলি মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে প্রসারিত হয় ও বৃক্ষরূপী নদীব্যবস্থা গড়ে তোলে।
2. সংকীর্ণ ‘V’ আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি:
ভূমির উচ্চতা তথা ঢাল সর্বাধিক থাকে বলে নদীগুলি খরস্রোতা হয়। একারণে প্রবল ক্ষয়কারী শক্তির প্রভাবে নদীগুলি নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে উপত্যকাকে গভীর করে এবং সংকীর্ণ ‘V’ আকৃতির উপত্যকা গঠন করে।
3. সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ম জলবিভাজিকা:
নদী উপত্যকা ক্রমশ গভীর ও প্রশস্ত হতে থাকে বলে জলবিভাজিকাগুলি ক্রমান্বয়ে সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ম হয়। এই পর্যায়ের শেষ অবস্থায় তীক্ষ্ম জলবিভাজিকার শীর্ষদেশে আদি শিলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।
4. বিবিধ ভূমিরূপ:
পর্যায়ক্রমে কঠিন ও কোমল শিলা স্তরের অবস্থানের জন্য প্রধান নদীর গতিপথ বরাবর জলপ্রপাত, ক্যাটারাক্ট প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।
5. মন্থকূপ সৃষ্টি:
যৌবনে নদীবাহিত বড়ো বড়ো বোল্ডার অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় নদীগর্ভে গোলাকার গর্তের সৃষ্টি করে, একে মন্থকূপ বলে। এর ফলে নদীখাত দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
6. ক্রমবর্ধমান আপেক্ষিক উচ্চতা:
নদীর নিম্নক্ষয় খুব বেশি হওয়ায় শৈলশিরার শীর্ষদেশ ও নদী উপত্যকার তলদেশের মধ্যে আপেক্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
7. ভূমির বন্ধুরতা বৃদ্ধি:
যৌবন অবস্থা যত এগোতে থাকে নদনদীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।এর ফলে ক্ষয়কার্যও বাড়তে থাকে। তেমনি ভূমির বন্ধুরতাও বাড়ে। যৌবন অবস্থার শেষ প্রান্তে সমগ্ৰ ভূমিভাগটি ক্ষয়কর্যের ফলে ব্যবচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
Read- পরিকল্পনা অঞ্চলের ক্রমবিন্যাস লেখ।
B. পরিণত অবস্থা:
যৌবন অবস্থার শেষে ক্ষয়কার্যের ফলে ভূমিভাগের উপর উত্থান পর্ব চলাকালীন চিহ্নসমূহ যখন প্রায় একেবারে মুছে যায়, তখন ভূমিরূপ পরিণত অবস্থা লাভ করে। এই সময়ে জলবিভাজিকা গুলির মস্তক অংশ তীক্ষ্ম হয়। নিম্ন এই অবস্থার ভূমিরূপ আলোচনা করা হল –
1. সুপ্রতিষ্ঠিত জলবিন্যাস:
মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে উপত্যকার বিস্তৃতি ঘটে এবং নিম্নস্থ শিলা স্তরের সঙ্গে নদীর সামঞ্জস্য বিধান সুসম্পূর্ণ হয়। সেই সঙ্গে নদীর জলবিন্যাস সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
2. অন্তর্হিত ভূমিরূপ:
পরিণত অবস্থায় ঢাল মসৃণতা লাভ করে বলে পূর্বেকার জলপ্রপাত, জলাশয় প্রভৃতি অন্তর্হিত হয়।
3. পর্যায়িত ঢালের সৃষ্টি:
উচ্চতা কমতে কমতে একটা সময় প্রধান নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর পার্শ্বচিত্রে অর্থাৎ উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত একটি পর্যায়িত ঢাল সৃষ্টি হয়।
4. ঢালু ভূমির উপস্থিতি:
পরিণত অবস্থায় ভূমির ব্যবচ্ছিন্নতা ও বন্ধুরতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি হয়। ফলে, ঢালু ভূমির উপস্থিতি উপত্যকা ও উচ্চভূমির চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
5. নদীর সংখ্যা হ্রাস:
পরিণত অবস্থার শেষের দিকে নদীর নিম্ন ক্ষয় অপেক্ষা পার্শ্বক্ষয় বাড়তে থাকে, এর ফলে নদীগুলি নিজ অববাহিকা অঞ্চলের নদীগুলিকে গ্ৰাস করে।
6. ক্রমহ্রাসমান আপেক্ষিক উচ্চতা:
পরিণত অবস্থা যত এগোতে থাকে, ব্যবচ্ছিন্ন ভূমির উচ্চ অংশ বা চূড়াগুলির এবং উপত্যকার তলদেশের মধ্যে আপেক্ষিক উচ্চতা হ্রাস পায়।
7. বিবিধ ভূমিরূপ:
আড়াআড়ি পার্শ্বচিত্র অনুসারে নদী উপত্যকার আকৃতি সংকীর্ণ ‘V’ থেকে প্রশস্ত ‘V’ তে পরিণত হয়। নদী উপত্যকায় প্লাবনভূমি এবং নদী বাঁকের সৃষ্টি হয়।.
Read- দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য কিছু অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন।
C. বার্ধক্য অবস্থা:
উপত্যকার নিম্নক্ষয় বন্ধ হওয়ার সময় বার্ধক্য অবস্থা শুরু হয়। এই পর্যায়ে পার্শ্বক্ষয় ও উপত্যকার প্রশস্তকরণ চলতে থাকে ও উপত্যকার নিম্নক্ষয় বন্ধ হয়ে যায়।জলবিভাজিকা গুলি দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। নিম্নে এই পর্যায়ের ভূমিরূপ আলোচনা করা হল –
1. অগভীর ও প্রশস্ত উপত্যকা:
ভূমিভাগের ঢাল কমে যায় বলে নদী উপত্যকা অগভীর এবং অত্যন্ত প্রশস্ত বা চওড়া হয়।
2. নদীর সংখ্যা হ্রাস:
পরিণত অবস্থার তুলনায় এই পর্যায়ে উপনদীর সংখ্যা কমে যায়।
3. প্রশস্ত ও অগভীর উপত্যকার সৃষ্টি:
পূর্ববর্তী নদী উপত্যকায় পলি সঞ্চয়ের ফলে নদী উপত্যকা ক্রমশ প্রশস্ত ও অগভীর হয়ে যায়।
4. প্লাবন ভূমি, স্বাভাবিক বাঁধ ও আঁকাবাঁকা গতিপথ:
নদীর প্লাবনভূমি খুব চওড়া হয় এবং দুপাশের স্বাভাবিক বাঁধ এর মধ্যে দিয়ে ধীরগতিতে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়।
5. বিবিধ ভূমিরূপ:
প্লাবনভূমিতে পরিত্যক্ত নদীবাঁক, জলাভূমি, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।
6. ঢাল হ্রাস:
ঢাল কমে যায় বলে আবহবিকার সৃষ্ট শিলাচূর্ণ দ্বারা উপত্যকার ঢাল ঢাকা পড়ে যায়।
7. বিনুনি আকৃতির নদী:
স্বল্প ঢালযুক্ত প্লাবনভূমি নদীর প্রবাহকে এতটাই কমিয়ে দেয় যে অনেক সময় নদী অসংখ্য শাখায় ভাগ হয়ে বিনুনির আকারে প্রবাহিত হয়।
8. সমপ্রায় ভূমির সৃষ্টি:
সুদীর্ঘ সময় ধরে ক্ষয়কার্যের ফলে সমগ্ৰ ভূমিভাগটি ক্ষয়কার্যের শেষ সীমা বা তার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ক্ষয়চক্রের এই পর্যায়ে গঠিত এই অনুচ্চ প্রায় সমতল ভূমিকে ডেভিস সম্প্রদায় ভূমি নামে পরিচিত করেছেন।
9. মোনাডনক:
সম্প্রদায় ভূমির উপর কঠিন শিলায় গঠিত বিচ্ছিন্ন ও স্বল্প উচ্চ টিলা বা পাহাড়কে মোনাডনক বলে।