নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে মৎস্য ক্ষেত্র গুলির বিকাশ লাভ বা উন্নতির কারণ শেখ।

 নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে মৎস্য ক্ষেত্রগুলির উন্নতির কারণ সম্পর্কে এই লেখা টিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। একাদশ শ্রেণীর জন্য প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নটি প্রায়শই পরীক্ষা তে এসে থাকে। সুতরাং প্রশ্নটি মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।

নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে মৎস্যক্ষেত্রগুলির বিকাশ

ভূমিকা:

সমুদ্রের সব অংশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ ধরা হয় না। কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বেশি পরিমাণ মাছ ধরা হয়। পৃথিবীর প্রধান মৎস্যচারণ ক্ষেত্রগুলি উত্তর গোলার্ধের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অগভীর সমুদ্রের মগ্নচড়া গুলিতে অবস্থিত। নিম্নে এই উন্নতির অনুকূল প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলি আলোচনা করা হল-

  • অনুকূল প্রাকৃতিক কারণসমূহ:

      1. অগভীর মগ্নচড়া:

                          অগভীর সমুদ্রের মহিসোপান অঞ্চলে যেখানে জলের গভীরতা 200 মিটার,সেই গভীরতা পর্যন্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে।এই অংশে জলের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে 20 ডিগ্ৰি সেন্টিগ্ৰেড।এটি এমন একটি আদর্শ উষ্ণতা, যে উষ্ণতায় সামুদ্রিক প্রাণী, প্ল্যাঙ্কটন ও উদ্ভিদ ভালোভাবে জন্মাতে ও বাঁচতে পারে।

এছাড়া স্থলভাগ থেকে ধুয়ে আসা আবর্জনার সাথে বিভিন্ন পোকামাকড় এখানে এসে জমা হয় ফলে মাছের খাদ্যের অভাব হয় না।এ কারণেই এই অঞ্চলের অগভীর সমুদ্রে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মৎস্যক্ষেত্রগুলি গড়ে উঠেছে।

      2. প্লাংকটন এর প্রাচুর্যতা:

                              প্লাংটন হল সমুদ্র জলে একপ্রকার ভাসমান অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী যা সমুদ্রস্রোতের সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভেসে বেড়ায়।এই প্ল্যাঙ্কটন  মাছের প্রধান খাদ্য।স্থলবিধৌত আবর্জনায় যেসব খনিজ লবণ থাকে, এই প্লাংটন গুলি তার দ্বারা পুষ্ট হয়।শীতল স্রোত আবর্জনা সমৃদ্ধ হিমশৈল বয়ে আনে। উষ্ণ স্রোতের মিলনে তা গলে যায়।শীতল ও উষ্ণ স্রোতের মিলনস্থলে সমুদ্রের তলদেশে সেজন্য প্রচুর আবর্জনার সঞ্চয় ঘটে। এর দ্বারা প্লাঙ্কটনগুলি পুষ্ট হয়। ফলে এই অংশে মাছের খাদ্যের অভাব হয় না।

      3. নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু:

                          শীতল নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বিশেষত যেসব স্থানের উষ্ণতা 20 ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম সেখানে মাছের সমাবেশ বেশি। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে বলে মাছ ধরার পর তা সহজে নষ্ট হয় না।ফলে মাছ সংরক্ষণের সুবিধা হয়।

      4. শিলাময় বন্ধুর ভূমিরূপ:

                         উপকূল সংলগ্ন স্থলভাগ বন্ধুর পর্বতময় বলে কৃষি কাজ করা যায় না।ফলে স্থানীয় অধিবাসীরা মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নরওয়ে, জাপান প্রভৃতি দেশের উপকূলভাগ বিস্তৃত পর্বতময়। এই দুই দেশ মৎস্য শিকারে খুবই উন্নত।

      5. ভগ্ন উপকূল রেখা:

                        নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বেশিরভাগ স্থানের সমুদ্র উপকূল ভগ্ন।এই ভগ্ন উপকূল মাছ ধরার উপযুক্ত বন্দর গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

      6. সরলবর্গীয় অরণ্য উপস্থিতি:

                   ‌‌  এ‌ই অরণ্যের গাছের কাঠ দিয়ে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার ইত্যাদি তৈরি করা হয়। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অক্ষাংশ সরলবর্গীয় অরন্যে পরিপূর্ণ।যন্ত্রচালিত নৌকা নির্মাণের জন্য এখান থেকে নরম কাঠ সরবরাহ করা হয়।যা মাছ সংগ্রহের উন্নতিতে সাহায্য করে।

  • অনুকূল অর্থনৈতিক কারণসমূহ:

      1. সুমিতের সরবরাহ:

                        মাছ সংগ্রহ চিরকালই একটি শ্রম নিবিড় শিল্প। মাছ শিল্পে যন্ত্রের প্রচলন সত্বেও শ্রমিকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। মাছকাটা, পরিষ্কার করা, লবণ দেওয়া, শুকানো, বাক্সবন্দী করা প্রভৃতি কাজে সুলভ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এই অঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় শ্রমিক এর অভাব হয়না।

       2. চাহিদা বাজার:

                            এশিয়া,ইউরোপ ও আমেরিকার দেশ গুলি মাঝারি থেকে ঘন জনবসতিপূর্ণ। ফলে এই সব দেশে মাছের খুব চাহিদা আছে। এজন্য নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে মৎস্য শিকার বিকাশ লাভ করেছে।

       3. পরিবহন:

                       এই অঞ্চলের উন্নত দেশগুলির পরিবহন ব্যবস্থা খুবই উন্নত মানের। এছাড়া মৎস্য বন্দরের সঙ্গে বিক্রয় কেন্দ্র গুলি বিভিন্ন পথের দ্বারা সংযুক্ত। প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হওয়ার জন্য ও ইন্টারনেট ব্যবস্থার কল্যাণে মৎস্যজীবীদের অতিদ্রুত সঠিক স্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

        4. আধুনিক প্রযুক্তি:

                          বর্তমানে উপগ্রহ চিত্র ও কম্পিউটারের সাহায্যে সমুদ্রের মধ্যে মাছের ঝাঁক এর গতি বিধি ও অবস্থান সহজেই ধরা যায়। ফলে সমুদ্রের মাছ শিকার করতে শ্রম ও সময় উভয়ই কম লাগে।

        5. উন্নত বন্দর:

                      বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় বন্দর গুলি সুরক্ষিত ও বিভিন্ন উপকরণের সুসজ্জিত। সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার গুলি সঙ্গে অতি সহজেই যোগাযোগ রাখা যায়, বিপদে আপদে উদ্ধারকার্য চালানো যায়।এজন্য ট্রলার গুলি গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যেতে ভরসা পায় না।

        6. মূলধনের প্রাচুর্য:

                                    মৎস্যশিল্পের জন্য প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ প্রয়োজন। মৎস্যজীবীরা ব্যাংক বীমা ও অন্যান্য আর্থিক কোম্পানিগুলি থেকে খুব সহজেই ঋণ পায়।ফলে মাছ শিকারীরা ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না।

        7. হিমঘর:

                     অতি আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ ধরার জন্য ধৃত মাছের পরিমাণ অনেক বেশি। এই পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছকে একসঙ্গে চালান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই অঞ্চলে বন্দর এর নিকট প্রচুর হিমঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

        8. মৎস্য ভিত্তিক শিল্পের উন্নতি:

                           মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর তেল নিষ্কাশন এবং অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদনের কারখানা বেশি থাকলে মৎস্য শিকার লাভজনক হয়। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলি উন্নত বলে এই ধরনের অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে।

উপরিউক্ত কারণগুলি নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে মৎস্য শিল্পের উন্নতিতে সহায়তা করেছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!