নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্য বলতে কী বোঝো?
উভয় গোলার্ধে ৩০° থেকে ৫০° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত মহাদেশগুলির পূর্বভাগে যেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার এবং গড় উষ্ণতা প্রায় ১৬°সেলসিয়াস। সেখানে বৃহৎ পত্রযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ চিরহরিৎ ও নাতিশীতোষ্ণ পর্ণমোচী বৃক্ষের সংমিশ্রিত যে বনাঞ্চল দেখা যায়,তাকে নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্য বা উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ চিরসবুজ ও পর্ণমোচী বনভূমি বলে।
Read– সমুদ্রজলের উষ্ণতার তারতম্যের কারণ গুলি লেখ।
নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্যের ভৌগোলিক অবস্থান লেখ।
সাধারণত মধ্য অক্ষাংশে মহাদেশ সমূহের পূর্বাংশে নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্যের বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।যেমন-
এশিয়া:
উত্তর-পূর্ব ও মধ্য চিন, দক্ষিণ জাপান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এই বনভূমি দেখা যায়।
ইউরোপ:
বেলজিয়াম,ফ্রান্সের উত্তরভাগ, জার্মানির দক্ষিণাংশ, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, রোমানিয়া, চেক।
উত্তর আমেরিকা:
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ- পূর্বাংশের বিভিন্ন রাজ্য, কানাডার দক্ষিণাংশ, মেক্সিকোর পার্বত্য ভূমি।
দক্ষিণ আমেরিকা:
উরুগুয়ে,চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে।
আফ্রিকা:
দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বাংশে এই অরণ্য দেখা যায়।
অন্যান্য:
নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়ায় দেখা যায়।
Read- নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে মৎস্য ক্ষেত্র গুলির বিকাশ লাভ বা উন্নতির কারণ শেখ।
নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্যের বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ।
- এই অরণ্যে পর্ণমোচী, চিরহরিৎ ও সরলবর্গীয় উদ্ভিদের একত্রে সমাবেশ দেখা যায়।
- বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি এবং মাটির ভিজে থাকে সেখানে বড় ও প্রশস্ত পাতার চির সবুজদার জন্মায়।
- একই প্রজাতির গাছের কাছাকাছি অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
- এই ধরনের বৃক্ষ গুলি কাণ্ড পুরু ছালে ঢাকা থাকে এবং পাতাগুলি পাতলা হয়। গাছগুলি একে অন্যের থেকে দূরে অবস্থান করে বলে অরণ্য তেমন গভীর বা ঘন হয় না।
- এই অরণ্যের তলদেশ জঙ্গলাকীর্ণ থাকে না।ফলে কাষ্ঠ আহরণে সুবিধা হয়।
- এখানকার গাছগুলি শীতকালে পত্রমোচন করলেও বছরের অন্য সময় গাছগুলি ঘন সবুজ পাতায় ঢাকা থাকে।
- অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমিতে পাইনজাতীয় সরলবর্গীয় গাছ জন্মায়।
নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহার লেখ।
মিশ্র বনভূমি অঞ্চলে নরম ও শক্ত দুই জাতের কাঠ পাওয়া যায়। ফলে মিশ্র বনভূমির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। যেমন-
1. কাষ্ট শিল্প:
নরম ও শক্ত কাঠের যোগান একই বনভূমি থেকে পাওয়ার কারণে এখানে কাষ্ঠ শিল্প খুবই উন্নত। আসবাবপত্র, যানবাহন নির্মাণ, জাহাজের পাটাতন, খেলাধুলার সরঞ্জাম, রেলের স্লিপার, প্লাইউড প্রভৃতি তৈরির জন্য এই অরণ্যের কাঠ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের মোট কাঠের চাহিদার প্রায় ১৫ থেকে ২০% কাঠ এই অরণ্য থেকে পাওয়া যায়।
2. জ্বালানি রূপে:
এই অরণ্যের নিম্ন শ্রেণীর কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন- শীতকালে ঘর গরম রাখতে আবার রান্নার কাজে প্রকৃতি।
3. চর্ম শিল্প:
ব্রাজিলের কুইব্রাকো গাছের ছাল থেকে ট্যানিন উৎপাদিত হয় যা চর্মশিল্পে অতি প্রয়োজনীয়।
4. আঠা তৈরি:
অ্যাশ ও পপলার প্রভৃতি গাছের ছাল থেকে আঠা পাওয়া যায়।
5. কাগজ শিল্প:
নরম কাঠের বনভূমি থেকে কাষ্ঠ মন্ড বা কাগজ মন্ড উৎপাদনে কাঁচামাল পাওয়া যায়।
6. রঙ শিল্প:
রং শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে তারপিন তেল এই বনভূমির উপজাত দ্রব্য।
7. সিরাপ:
ম্যাপল গাছের রস থেকে চিনি ও সিরাপ তৈরি হয়।
8. অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজ:
বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা ও পরিশোধনের মাধ্যমে অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদন করা ছাড়াও এখানে পশু পালন ও ট্রাকফার্মিং অর্থাৎ বাজার ভিত্তিক সবজি ও ফল চাষ করা হয়।
নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্যের প্রধান প্রধান বৃক্ষ সমূহ কি কি ?
এই অঞ্চলে চিরহরি গাছগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অস্ট্রেলিয়ার ইউক্যালিপটাস, আফ্রিকার নাটালে ওয়াটল, দক্ষিণ পূর্ব ব্রাজিলে পারানা পাইন ও উইব্রাকো, জাপানের কর্পূর প্রভৃতি ।
পর্ণমোচী বনভূমির অধিকাংশ স্থানে পপলার, ওয়ালনাট, ওক, বিচ, এলম, বার্চ, চেষ্টনাট, অ্যাশ, হিকরি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় সরলবর্গীয় বৃক্ষ লক্ষ্য করা যায়।