নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য বা চিরহরিৎ অরণ্য কাকে বলে?
নিরক্ষীয় জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলে অর্থাৎ নিরক্ষরেখার উভয় দিকে 5° থেকে 10° অক্ষাংশের মধ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও পর্যাপ্ত উষ্ণতার প্রভাবে শক্ত কাঠের গাছপালা সমন্বিত যে ঘন অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে তাকে ক্রান্তীয় বা নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য বা চিরহরিৎ অরণ্য বলা হয়।
নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর অবস্থান বলে এবং সারাবছর সবুজ পাতা থাকে বলে এই অরণ্যকে নিরক্ষীয় চিরহরিৎ অরণ্য বলা হয়।
Read– জীবমন্ডল সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন(দ্বিতীয় ভাগ)।
এই অরণ্যের ভৌগোলিক বন্টন আলোচনা কর।
নিরক্ষরেখার উভয়দিকে 5° থেকে 10° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশে যেসব অঞ্চলে বাৎসরিক বৃষ্টিপাত 200 থেকে 250 সেমি এবং উষ্ণতা 25° থেকে 27°, সেইসমস্ত অঞ্চলে চিরহরিৎ বনভূমির সৃষ্টি হয়।
নিম্ন এই অরণ্যের ভৌগোলিক অবস্থান বর্ণনা করা হল –
1. দক্ষিণ আমেরিকা:
আর্দ্র আয়ন বায়ুর জন্য দক্ষিণ আমেরিকার মতো মহাদেশের পূর্বাংশে 15° থেকে 25° অক্ষাংশেও দেখা যায়।
আমাজন অববাহিকা, ব্রাজিল, পেরু, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, গায়ানা জুড়ে এই অরণ্য অবস্থিত।
✓ দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী অববাহিকা ও ওরিনকো নদীর উচ্চ অববাহিকা বরাবর এই অরণ্য দেখা যায়। এর নাম ‘সেলভা’ এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম ও গভীরতম ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য। একে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ ও বলে।
2. আফ্রিকা মহাদেশ:
কঙ্গো অববাহিকা, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, জাইরে, ক্যামেরুন, গ্যাবন, উগান্ডা, নাইজেরিয়ার দক্ষিণাংশ, কাটাঙ্গা, মাদাগাস্কারের পূর্বাংশ।
3. উত্তর আমেরিকা:
এই মহাদেশের দক্ষিণাংশে পানামা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, এলর্ব সালভাডার, মেক্সিকোতে এই বনভূমি দেখা যায়।
4. এশিয়া:
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এই অরণ্য দেখা যায়।
5. ওশিয়ানিয়া:
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ও নর্দান টেরিটরি, পাপুয়া নিউগিনিতে এই অরণ্য দেখা যায়।
Read– জীবমন্ডল সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন(প্রথম ভাগ)।
ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য বা নিরক্ষীয় চিরহরিৎ অরণ্যের বৈশিষ্ট্য লেখ।
ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য এর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি নিম্নরূপ –
1. ঘন অরণ্য:
2. ঘন চাঁদোয়ার সৃষ্টি:
এখানকার গাছগুলির বড়পাতাসহ ডালপালা গুলি বিস্তার করে গায়ে গায়ে লেগে থাকে এবং খোলা ছাতার মতো চাঁদোয়া বা ক্যানোপি তৈরি করে।এর ফলে সূর্যালোক বনের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না।
3. চিরগোধূলী অঞ্চল:
বনভূমি অত্যাধিক ঘন এবং জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বনভূমি এত ঘন যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো ভালো ভাবে বনভূমির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। স্থানে স্থানে যেন রাতের অন্ধকার নেমে আসে। তাই এই বনাঞ্চলকে চিরগোধূলী অঞ্চল বলে।
4. উদ্ভিদের জন্ম – বৃদ্ধি:
উষ্ণ, আর্দ্র পরিবেশের জন্য এই অঞ্চলে অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায়। সমস্ত উদ্ভিদ যেমন খুব দ্রুত জন্মায় তেমনি খুব দ্রুত বৃদ্ধিও পায়। কয়েকদিনের মধ্যে দু-এক মিটার বেড়ে যায়।
5. বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের সমাবেশ:
এই অরণ্যে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ পাশাপাশি সহাবস্থান করে। এই অরণ্যে কয়েক হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায়।
6. চিরহরিৎ অবস্থা:
বৃষ্টি বেশি হয় বলে গাছের পাতা গুলি বেশ প্রশস্ত ও লম্বা হয় এবং সারাবছর ধরে সবুজ থাকে। তাই এই অঞ্চলের বনভূমি চিরহরিৎ অরণ্য নামে পরিচিত।
7. দুর্ভেদ্যতা:
বনভূমি আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে, মাটি খুব নরম এবং হিংস্র জীবজন্তর জন্য এই বনের মধ্যে প্রবেশ করা খুবই কষ্টসাধ্য।
8. উদ্ভিদের দৈর্ঘ্য:
বনভূমির গাছগুলি খুবই লম্বা। গাছগুলি লম্বায় প্রায় 40 থেকে 50 মিটার বা তারও বেশি। বনভূমিতে যেহেতু সূর্যালোক সেভাবে প্রবেশ করে না। তাই সূর্যালোকের জন্য গাছগুলি দ্রুত লম্বা হওয়ার চেষ্টা করে।
9. গাছের স্তরবিন্যাস:
এই বনভূমিতে উচ্চতার ভিত্তিতে গাছগুলিকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা –
- সর্বোচ্চ স্তর(30-45 মিটার)
- মধ্যস্তর(15-30 মিটার)
- নিম্নতম স্তর(5-15 মিটার)
এছাড়া,
- এই অঞ্চলে ঋতুবৈচিত্র না থাকায় বৃক্ষগুলিতে বর্ষবলয় দেখা যায় না।
- এই অঞ্চলের তলদেশে শৈবাল, গুল্ম, আগাছা প্রভৃতি জন্মাতেও দেখা যায়।
Read– নাতিশীতোষ্ণ মিশ্র অরণ্য সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন।
নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্যের উল্লেখযোগ্য বৃক্ষের নাম লেখ।
নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্যের শক্ত ও ভারি কাঠের বৃক্ষ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৃক্ষ গুলি হল –
আয়রন উড, রোজ উড, মেহগনি, ব্রাজিল নাট, আবলুস, সেগুন, রবার, তৈলপাম, টাগুয়ানাট, ব্রাসিলিয়েনসিস, কোক ইত্যাদি।
নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্যের বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক ব্যবহার লেখ।
সমগ্ৰ বিশ্বে নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্যের আয়তন প্রায় 49 কোটি হেক্টর।এই বিস্তীর্ণ অরণ্য থেকে বছরে প্রায় 153 কোটি টন কাষ্ঠ সম্পদ সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার উপজাত দ্রব্য সরবরাহে এই অরণ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
1. কাষ্ঠশিল্প:
এই অরণ্যে মেহগনি, আবলুস, সেগুন, আয়রন উড প্রভৃতি গাছের কাঠ খুব শক্ত ও মজবুত। এইসব কাঠ দিয়ে রেলের স্লিপার, জাহাজের পাটাতন নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি, গৃহ নির্মাণ, শৌখিন কাঠের দ্রব্য, তৈরি প্রভৃতি নানা কাজে এইসব কাঠ ব্যবহৃত হয়। এই অরণ্যেও বালসা নামে যে গাছ জন্মায়, তার কাঠ খুব হালকা, মজবুত এবং শব্দ ও কম্পন প্রতিরোধক। এজন্য বিমানের ভিতরের ঘর তৈরি করা হয়।
2. জ্বালানি কাঠ:
প্রধান প্রধান বৃক্ষ ছাড়া বনভূমির অন্যান্য গাছের কাঠ, আগাছা, লতানো উদ্ভিদ গুলি জ্বালানি রূপে ব্যবহৃত হয়। তবে, জ্বালানি কাঠের সংগ্রহ খুব বেশি হয় না।
3. অন্যান্য উপজাত দ্রব্য:
- বিভিন্ন পাম জাতীয় বৃক্ষ থেকে পায় তেল তৈরি করা হয়।
- জাপোটি ও সাপেডিলা গাছের আঠা থেকে চুইংগাম তৈরি করা হয়।
- রবার গাছের রস সংগ্রহ করে তার থেকে প্রাকৃতিক রবার প্রস্তুত করা হয়।
- টাগুয়ানাট থেকে বোতাম তৈরি করা হয়।
- ম্যানিলা হেম্প থেকে দড়ি, থলে তৈরি করা হয়।
- সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে কুইনাইন ঔষধ তৈরি করা হয়।
This post was updated on 2023-02-22 17:58:25.