ভূমিকা:
- মহীসঞ্চরণ মতবাদ।
- সমুদ্রবক্ষের সম্প্রসারণ মতবাদ
পাত সংস্থান তত্ত্ব:
সমগ্ৰ পৃথিবীব্যাপী পাতের উদ্ভব, সৃষ্টি, চলন, বিবর্তন, বিরূপণ, বিভিন্ন ভূমিরূপ, আগ্নেয়গিরির উদ্ভব ও অবস্থান, তপ্তবলয়, বৃত্তচাপীয় দ্বীপমালা এবং মহাদেশগুলির ভৌগোলিক অবস্থান পরিবর্তন ও সমুদ্রবক্ষের আকার-আকৃতির পরিবর্তন প্রভৃতি যে তত্ত্ব বা মতবাদ দ্বারা প্রকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তাকে পাত সংস্থান তত্ত্ব বলে। আবার বলা যায় যে, পাতের বিবর্তন, প্রকৃতি, গতি ও তার ফলাফল এই সমস্ত পদ্ধতিগুলিকে একত্রে পাত সংস্থান তত্ত্ব বলে।
মূল বক্তব্য:
পাত সংস্থান তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীর কঠিন আবরণ অর্থাৎ ভূত্বক কতকগুলি কঠিন শিলাপাত দ্বারা আবৃত। এদের গভীরতা অনুভূমিক বিস্তার অপেক্ষা অনেক কম। এই পাতাগুলি প্রচন্ড উত্তপ্ত ও সান্ধ্য অ্যাসথেনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান। এই পাতাগুলি একে অপরের থেকে চ্যুতিতল দ্বারা বিভাজিত। সমগ্ৰ পৃথিবীতে 7টি বড়ো, 8 টি মাঝারি এবং 20 টি বা তার বেশি ছোটো বা ক্ষুদ্র পাত বর্তমান। পাতাগুলি প্রায় 70-80 km পুরু হয়। এই পাতাগুলি পরিচলন স্রোতের প্রভাবে সর্বদা গতিশীল। গতিশীলতার কারণে পাতাগুলি কখনো পরস্পরের কাছে, কখনো বা পরস্পরের থেকে দূরে সরে যায়, আবার কখনো কখনো পাতাগুলি পাশ কাটিয়ে একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়।
পাত সঞ্চালনের কারণ:
ভূবিজ্ঞানীগণ ভূত্বকীয় পাতের সঞ্চালনের নিম্নলিখিত কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছেন। যথা –
1. পরিচলন স্রোত:
ভূবিজ্ঞানী আর্থার হোমসের মতে পরিচলন স্রোত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাত সঞ্চালনের জন্য দায়ী। ঊর্ধ্বমুখী গলিত পদার্থ কঠিন ভূত্বকের কাছাকাছি এসে দুপাশে সরে যায় ও পরে নিম্নগামী হয়ে একটি পরিচলন কক্ষ সৃষ্টি করে। এভাবে সৃষ্ট দুটি পরিচলন কক্ষ পাশাপাশি অবস্হান করলে ঊর্ধ্বমুখী অপসারী স্রোতের উপরে ভাসমান ভূত্বকীয় পাতগুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। আবার নিম্নমুখী অভিসারী স্রোতের ওপর ভাসমান পাতগুলি একে অপরের দিকে চলে আসে। এভাবে ভূঅভ্যন্তরস্থ পরিচলন স্রোতের প্রভাবে ভূত্বকীয় পাতের সঞ্চরণ ঘটে।
2. ম্যাগমার উত্থান:
প্রতিসারী পাতসীমানা বরাবর ম্যাগমার উত্থান প্রবল ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করে। ফলে দুপাশের পাত দুটি একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। এছাড়া, গুরুমন্ডলে 20-25 টি অতিতপ্ত স্থান আছে যাকে প্লিউম বলে। ওইসব স্থানগুলি থেকে ম্যাগমা উপরের দিকে উঠে এলে ভূত্বক ফুলে ওঠে ও মা পাতলা হয়ে যায়। ফলে একপ্রকার অনুভূমীক বল সৃষ্টি হয় যা দ্বারা পাতাগুলি সঞ্চালিত হয়।
3. অভিকর্ষজ টান:
প্রতিসারী পাতসীমানা বরাবর মধ্য-সাগরীয় শৈলশিরা ও অভিসারী পাত সীমানা বরাবর সৃষ্ট খাতের মধ্যে একটি ঢালুতল সৃষ্টি হয়। এই তল বরাবর অভিকর্ষজ টানে পাত সঞ্চালিত হয়।
4. পাতের নিমজ্জন জনিত টান:
অভিসারী পাত সীমানা বরাবর পাতের নিমজ্জনের কারণে পাতের অপর অংশ টানজনিত বলের সৃষ্টি হয়। ফলে পাতের সঞ্চলন ঘটে।
পাত ভূগাঠনিকের প্রমাণ:
পাতগুলির অস্তিত্ব ও তাদের গতিশীলতা সম্পর্কে প্রমাণস্বরূপ নিম্নলিখিত বিষয়গুলি উল্লেখ করা যায়। যথা –
1. সম্প্রসারণ গতির প্রভাবে সীমানা থেকে প্লেটগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যে পৃথক পৃথক ভূভাগ সৃষ্টি করেছে, যদি সেগুলিকে সংকুচিত করে পুনরায় একত্র করা যায় তাহলে এরা অতিসুন্দর ভাবে মিলে যায়। যেমন – আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরবর্তী ভূভাগ।
2. পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে পাত গুলির গতিশীলতার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অতীতে বারবার পরিবর্তন হয়েছে।
3. পৃথিবীতে পাতের সীমানা বরাবর বিন্যস্ত আগ্নেয়গিরি গুলির অবস্থান পাত ভূ-গঠনিক তত্ত্বের স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য যুক্তি দেয়। কারণ দুটি পাতের সংঘর্ষের ফলে অগ্নুৎপাত হয়ে থাকে।
পাত সীমানা ও ভূ-বিবর্তনের ভূমিকা:
পাতের সীমানা বা কিনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ সমস্ত ভূ-গাঠনিক ক্রিয়া-কলাপ এই অঞ্চলের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়। যেমন পর্বত গঠন, চ্যুতি, অগ্নুৎপাত প্রভৃতি কার্যকলাপ অনুসারে এই পাঁচ কিনারাগুলি তিনভাগে বিভক্ত। যথা –
1. প্রতিসারী বা গঠনমূলক পাত সীমানা:
যে সীমানা বরাবর দুটি ভূত্বকীয় পাত পরস্পরের বিপরীত দিকে দূরে সরে যায় তাকে প্রতিসারী বা গঠনকারী পাত সীমানা বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী পরিচলন স্রোতের ফলে মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরার চূড়া বরাবর দুটি পাতের বিপরীতমুখী সরণ ঘটে। দুটি প্লেটে পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেলে যে ফাঁকের সৃষ্টি হয় তা অ্যাসথেনোস্ফিয়ার থেকে উঠে আসা ব্যাসল্ট জাতীয় পদার্থ দ্বারা পূর্ণ হয়। এরূপ প্রক্রিয়া অব্যাহত গতিতে চলতে থাকলে নতুন ভূত্বকের সৃষ্টি হয়। প্রতিসারী পাত সীমানায় সংশ্লিষ্ট ভূ-গাঠনিক বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
- নতুন মহাসাগরীয় ভূত্বক সৃষ্টি
- মধ্য সাগরীয় শৈলশিরা সৃষ্টি
- গ্রস্ত উপত্যকা সৃষ্টি
- সমুদ্রতলের বিস্তার ও সমুদ্র সৃষ্টি
- ভূমিকম্প।
2. অভিসারী বা বিনাশকারী পাত সীমানা:
যে সীমানা বরাবর দুটি শিলামন্ডলীয় পাত পরস্পরের মুখোমুখি অগ্রসর হয় তাকে অভিসারী পাক সীমানা বলে। এক্ষেত্রে দুটি পাত পরস্পর একই দিকে অগ্রসর হয় এবং দুটি পাতের অগ্রবর্তী প্রান্ত পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অপেক্ষাকৃত ভারী পাতটি হালকা পাতের নীচে প্রবেশ করে এবং ভারী পাতটির নিমজ্জিত অংশের বিনাশ ঘটে। অভিসারী পাতসীমানাকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা –
- মহাদেশীয় – মহাদেশীয় পাত সীমানা
- মহাদেশীয় – মহাসাগরীয় পাত সীমানা
- মহাসাগরীয় – মহাসাগরীয় পাত সীমানা।
3. নিরপেক্ষ বা সংরক্ষণশীল পাত সীমানা:
এরকম পাত সীমানায় দুটি পাত বিশাল ফাটল বরাবর পাশাপাশি চলাচল করে। পাত দুটি পরস্পরের সংঘর্ষে আসে না, পরস্পর থেকে দূরে সরে যায় না। ফলে এরূপ সীমানায় গঠন ও বিনাশ কিছুই হয় না বলে এরকম পাত সীমানাকে নিরপেক্ষ পাত সীমানা বলে।
উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের সান আন্দ্রিজ ফল্ট এরূপ পাত সীমানার বিখ্যাত উদাহরণ। সান আন্দ্রিজ ক্রোমটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত ও উত্তর আমেরিকা পাতের সীমানা।
সমালোচনা:
পাত ভূ-গাঠনিক মডেল ভূপৃষ্ঠের বহু বৈচিত্রের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিলেও অনেক বৈচিত্রের তর্কাতীত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ১৯৭৪ সালে ম্যাক্সওয়েল একটি তথ্য সমৃদ্ধ নিবন্ধে এরূপ অনেক বিষয়ের প্রতি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এগুলি সম্বন্ধে সমর্থকরা বলে থাকে, বহু প্রশ্নের ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে পাওয়া গেছে, অনেকগুলি অসম্পূর্ণ তবে ভুল নয়।
- পর্বতের উৎপত্তির একটি সর্বস্বীকৃত প্রক্রিয়া এবং গড়ে সাগরপৃষ্ঠের উত্থান পতন এরূপ দুটি ঘটনার L.L.Slos উদাহরণ দিয়ে একই কালে বিভিন্ন ভূ-বিভাগের ওঠানামা প্রমাণ করলেও তার কারণ নির্দেশ করতে পারেননি।
- জর্ডান দেখালেন শিলামন্ডলের নীচের অ্যাসথেনোস্ফিয়ার সাগরতলের তুলনায় অনেক বেশি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এরূপ অবস্থায় প্লেট সঞ্চারকে কিভাবে প্রভাবিত করবে তার স্থির করা যায়নি।
- ক্যারে মনে করেন যে, ভূগোলকের আয়তনের বৃদ্ধি ঘটে চলেছে। এই ভূ-ভাগগুলি বৃদ্ধির আগে থেকেই বর্তমান। ক্যারের মতবাদ সাগরতলের প্রশাসনের সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
This post was updated on 2023-02-22 17:57:54.