পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অসম জনবন্টনের প্রাকৃতিক কারণগুলি আলোচনা করো।

   

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অসম জনবন্টনের প্রাকৃতিক কারণগুলি আলোচনা করো।
অসম জনবন্টনের প্রাকৃতিক কারণ

  ভূমিকা:

                 বসবাসের উপযোগী অনুকূল পরিবেশের তারতম্যের জন্য পৃথিবীর সর্বত্র জনসংখ্যার বন্টন তথা জনঘনত্ব সমান নয়। বর্তমানে পৃথিবীতে ৮০০ কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করে। এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে নেই। যেসব কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অসম জনবন্টন দেখা যায় তাদের প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  1. প্রাকৃতিক কারণসমূহ এবং
  2.  অর্থনৈতিক কারণসমূহ

  • প্রাকৃতিক কারণসমূহ:

                                 জনসংখ্যা বন্টনে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে কারণগুলি আলোচনা করা হলো-

1. ভূপ্রকৃতি:

               জনসংখ্যা বন্টনের ওপর ভূ-প্রকৃতির প্রভাব সর্বাধিক। উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে বা মালভূমি অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি বন্ধুর হওয়ায় মানুষের জীবনধারণের সুযোগ সুবিধা কম। পার্বত্য অঞ্চলে কৃষিকাজের উপযোগী উর্বর সমতল ভূমির অভাব, রাস্তাঘাট নির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ,ভারী শিল্প গড়ে তোলার পক্ষে প্রতিকূল, ভূমি ধস এই অঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই সব কারণের জন্য এই অংশে মানুষের বসবাস খুবই কম। তবে, পার্বত্য অঞ্চল অপেক্ষা মালভূমি অঞ্চলে জন ঘনত্ব কিছুটা বেশি।


অপরদিকে সমভূমি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উর্বর সমতল ক্ষেত্র, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা প্রভৃতি কৃষিকাজ, শিল্প গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে, এই অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দাক্ষিণাত্যের মালভূমি ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল অপেক্ষা গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি।

2. জলবায়ু :

           জনসংখ্যা বন্টনে জলবায়ুর ভূমিকা অপরিসীম। জলবায়ু পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, কৃষিকাজ,শিল্প উৎপাদন প্রভৃতি ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে।উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষের বেশভূষা, খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যাভ্যাস,কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন ও উৎপাদন ব্যবস্থা- নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের থেকে ভিন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ুর পার্থক্যকে দায়ী করা হয়। পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলের জলবায়ু কৃষিজ ফসল উৎপাদনের উপযোগী, সেইসব অঞ্চলে জনবন্টন এর আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।

উচ্চ অক্ষাংশঅসহনীয় শৈত্যের কারণে, নিরক্ষীয় অঞ্চল অস্বাস্থ্যকর উষ্ণ-আদ্র জলবায়ু জন্য এবং শীতল ও উষ্ণ মরু অঞ্চল অতি শুষ্ক জলবায়ুর জন্য মনুষ্য বাসের অনুপযোগী। তাই,এই অঞ্চলে জন ঘনত্ব কম।

অস্বাস্থ্যকর উষ্ণ আদ্র জলবায়ুর জন্য দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন, আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা এবং শুষ্ক উষ্ণ জলবায়ুর জন্য আফ্রিকার সাহারা,দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা , ভারতের থর মরুভূমি অথবা চির তুষারাবৃত মেরু অঞ্চল বা হিমশীতল পার্বত্য অঞ্চলে অসহনীয় জলবায়ুর জন্য মানুষের বসবাস খুবই কম।

3. মৃত্তিকা :

               মাটির গুণাগুণ আংশিক ভাবে জনবন্টন এর ঘনত্ব কে নিয়ন্ত্রন করে। পৃথিবীর হিমবাহ ও বরফঢাকা অঞ্চলগুলিতে মাটি না থাকায় সেগুলি জনশূন্য বললেই চলে। উচ্চ-মধ্য অক্ষাংশ এর  পডসল মাটি ও ক্রান্তীয় অঞ্চলের ল্যাটেরাইট মাটি নিবিড় কৃষি কার্যের পক্ষে বাধাস্বরূপ বলে, এই সমস্ত অঞ্চলে বিরল জনঘনত্ব লক্ষ্য করা যায়।

অন্যদিকে জাপান ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরি অঞ্চলের কৃষ্ণ মৃত্তিকা, সিন্ধু ও হোয়াংহো নদীর অববাহিকার পলিমাটি, মধ্য ও উপক্রান্তীয় অক্ষাংশের তৃণভূমির মাটি উর্বর বলে জনঘনত্ব বেশি দেখা যায়।

পলি মৃত্তিকা সমৃদ্ধ গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল কৃষি কাজের উপযোগী হওয়ায় এই অঞ্চলে জনাধিক্য ঘটেছে। ভারতের মালভূমি অঞ্চলের ল্যাটেরাইট সমৃদ্ধ অনুর্বর মৃত্তিকায় চাষবাস তেমনভাবে গড়ে না উঠায় জন আধিক্য তেমন ঘটেনি।

4. শিলা :

            জনসংখ্যার ঘনত্ব নির্ধারণে শিলার প্রভাব উল্লেখযোগ্য। ভূপৃষ্ঠে বা ভূ-অভ্যন্তরের জলের সহজলভ্যতা নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠের শিলার প্রকৃতির উপর। বেলে পাথর বা চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে শিলার প্রবেশ্যতা বেশি হওয়ায় জল সহজেই ভূ-অভ্যন্তরে চলে যায়।জলের অভাবে যেমন চাষবাস হয় না,তেমনি এই অঞ্চলে বসতি গড়ে ওঠে না। আবার প্রবেশ্য শিলাস্তরে নিচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর অবস্থান করলে ভূগর্ভে জলের সঞ্চয় ঘটে। ফলে, পানীয় জলের যোগান ও কৃষি ক্ষেত্রে জল-সরবরাহ অক্ষুন্ন থাকে। জলের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে জনবসতি বিস্তার লাভ করে।

5. খনিজ সম্পদের প্রাপ্তি :

                         জনসংখ্যা বন্টনের ক্ষেত্রে শক্তি সম্পদ ও খনিজ মৌলের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। উষ্ণ মরু অঞ্চল ও বন্ধুর মালভূমি অঞ্চলে জনবসতির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হলেও কোনো কোনো স্থানে খনিজ দ্রব্যের উপস্থিতির জন্য ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে। অরণ্যে ঢাকা বন্ধুর মালভূমি অঞ্চলের কিরিবুরু,মেঘাতুবুরু ও বোলানিতে লৌহখনি গুলিকে কেন্দ্র করে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে।মধ্যপ্রাচ্যের মরুপ্রায় অঞ্চলগুলিতে খনিজ তেলের অবস্থানের জন্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা মরুভূমিতে নাইট্রেট খনির অবস্থানের জন্য ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলে সোনার খনিকে কেন্দ্র করে কালগুর্লি ও কুলগার্ডি শহর গড়ে উঠেছে।

6. জলের প্রাপ্যতা :

                     কোন অঞ্চলের চাষের উন্নতি যেমন নির্ভর করে জলের প্রাপ্যতার ওপর,তেমনি জনবিন্যাস ও ঘনত্ব নির্ভর করে কৃষির উন্নতি ও পানীয় জলের প্রাপ্যতার ওপর। পৃথিবীর জনবিন্যাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ জনবসতি পানীয় জলের উৎস কে ঘিরে গড়ে উঠেছে।জলের অভাব ও আধিক্য কোনোটাই জনবিন্যাসের অনুকূল অবস্থা নয়।

জলাধিক্যের কারণে নদীর তীরবর্তী প্লাবনভূমিতে (জলাভূমি) এবং জলাভাবে ক্লিষ্ট মরু অঞ্চলে তেমনভাবে বসতি গড়ে উঠতে পারে না।আবার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে (লিবি অঞ্চলে) জলের যেমন অভাব ঘটে না, তেমনি এই অঞ্চল অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় বন্যার জল প্রবেশ করতে পারে না। তাই,এই অঞ্চলগুলিতে জনঘনত্বের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।

                  উপরোক্ত প্রাকৃতিক কারণ গুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে পৃথিবীর সর্বত্র সমান জনবসতি বা জনো বন্টন সম্ভব নয়।

Leave a Comment

error: Content is protected !!