বায়ুমণ্ডল:
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত যে গ্যাসীয় আবরণটি পৃথিবীকে বেস্ট রান করে আছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস জলীয় বাষ্প ধূলিকণা প্রভৃতির দ্বারা সংঘটিত এই হালকা আবরণটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি টানে ভূপৃষ্ঠের সাথে সরাসরি ভাবে যুক্ত।
বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস:
বিখ্যাত জলবায়ুবিদ পিটারসন বায়ুমণ্ডলকে 6টি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা –
- ট্রপোস্ফিয়ার
- স্ট্যাটাস্ফিয়ার
- মেসোস্ফিয়ার
- থার্মোস্ফিয়ার
- এক্সোস্ফিয়ার
- ম্যাগনেটিস্ফিয়ার
A. ট্রপোস্ফিয়ার:
বৈশিষ্ট্য:
- এই স্তরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে মেরু অঞ্চলে প্রায় আট থেকে নয় কিলোমিটার পর্যন্ত এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত
- পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মোট গ্যাসীয় পদার্থের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং প্রকৃতপক্ষে সমস্ত জলীয় বাষ্প, ধূলিকণা এই স্তরের সীমাবদ্ধ।
- ট্রপোশিয়ারের ঊর্ধ্বসীমাকে ট্রপোকাস বা স্তব্ধ স্তর বলে অর্থাৎ ট্রপোপস হল ট্রপোস্ফিয়ার ও স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের সীমানা নির্দেশক।
- এই স্তরে ভূপৃষ্ঠ থেকে যতই ঊর্ধ্বে যাওয়া যায় বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা ততোই কমতে থাকে প্রতি এক হাজার মিটার উচ্চতায় গড়ে ৬.৫° সেলসিয়াস হারে বায়ুর উষ্ণতা কমে।
B. স্ট্রাটোস্ফিয়ার:
ট্রপোস্ফিয়ারের উর্ধ্বের বায়ুস্তরটি স্ট্রাটোস্ফিয়ার নামে পরিচিত। ট্রপোস্ফিয়ারের উর্ধ্বে 50 কিলোমিটার পর্যন্ত এই স্তর বিস্তৃত। এই স্তরের বায়ুতে জলীয় বাষ্প নেই, ফলে ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনাও নেই তাই এই স্তরের নাম শান্ত মন্ডল।
বৈশিষ্ট্য:
- এই স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। 25 কিলোমিটার পর্যন্ত এই বাড়ার হার সামান্য হলেও এর উর্ধ্বে এই হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং সর্বোচ্চ উচ্চতায় তা 0°C সএসে পৌঁছায়।
- স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উর্ধ্বসীমা কে স্ট্রাটোপজ বলে। অর্থাৎ স্ট্যাটওপাস হল স্ট্রাটোস্ফিয়ার ও মেসোস্ফিয়ারের সীমানা নির্দেশক।
- স্ট্যাটাসফিয়ারের বায়ুস্তর প্রায় মেঘমুক্ত। সামান্য ধূলিকণা থাকলেও জলকণা শূন্য। ফলে এই স্তর ঝড়-বৃষ্টি-বায়ুপ্রবাহের সম্ভাবনা থেকে মুক্ত। এই কারণে দ্রুত গতি সম্পন্ন জেট বিমানগুলি ঝড়-বৃষ্টি এড়াবার জন্য স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে চলাচল করে।
- এই স্তরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো যে এই স্তরের ঊর্ধ্ব অঞ্চলে ওজোন গ্যাসের অবস্থান আছে। ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় 24 থেকে 40 কিমি এর মধ্যে। এই ওজোন স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে জীবজগৎকে রক্ষা করে।
C. মেসোস্ফিয়ার:
গ্রিক শব্দ ‘Meso’ এর অর্থ মধ্যম ভাগ। স্ট্রাটো-পজের পর থেকে মেসোস্ফিয়ারের শুরু। এই স্তরটি নিম্ন বায়ুমন্ডলের সর্বোচ্চ স্তর এবং সমমন্ডলের শেষ স্তর। এই স্তরটির বিস্তার 50 থেকে 80 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত।
বৈশিষ্ট্য:
- এই স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমে। 80 কিমি উচ্চতায় বায়ুর উষ্ণতা সর্বনিম্ন -83°C হয়। মেসোস্ফিয়ার হল বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে শীতলতম স্তর।
- এই স্তরে কিছু জলীয় বাষ্প অনুপ্রবেশ করায় মেঘের সঞ্চার হয়। কিন্তু অত্যাধিক ঠান্ডার জন্য জলীয়বাষ্প বরফ কণায় পরিণত হয়। এই বরফ কণা সমৃদ্ধ পাতলা মেঘ সাধারণত নকটিলুসেন্ট ক্লাউড নামে পরিচিত।
- বায়ুর চাপ এই স্তরে খুবই কম এবং এই চাপ ক্রমশ উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে কমতে থাকে। 50 কিলোমিটার উচ্চতায় এই চাপ থাকে প্রায় 1 মিলিবারের কাছাকাছি এবং 80 থেকে 90 কিলোমিটার উচ্চতায় তা দাঁড়ায় 0.01 মিলিবার।
- এই স্তরের অপর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এই স্তরে পৃথিবীর বাইরের উল্কাপিণ্ড প্রবেশ করে বায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষে জ্বলে পুড়ে যায়।
- মেসোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ অংশে যেখানে উষ্ণতা আর কমে না বা স্থির থাকে, সেখানে একটি প্রান্তিক স্তর দেখা যায় যার নাম মেসোপজ। এর উপরে উষ্ণতা আবার বৃদ্ধি পায়।
D. থার্মোস্ফিয়ার:
মেসোস্ফিয়ারের পর বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তরের নাম থার্মোস্ফিয়ার। ‘Thermo’ কথার অর্থ উষ্ণতা এবং ‘Sphere’ কথার অর্থ মন্ডল অর্থাৎ থার্মোস্ফিয়ারের অর্থ উষ্ণমন্ডল। বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই স্তরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে, উষ্ণতা খুব বেশি থাকে বলে এই স্তরের নাম থার্মোস্ফিয়ার। এই স্তর 80 কিলোমিটার থেকে 480 কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
বৈশিষ্ট্য:
- এই স্তরে বায়ুর উষ্ণতা উচ্চতার সঙ্গে দ্রুত ঘরে বৃদ্ধি পায়।
- ৪৮০ কিলোমিটার উচ্চ বায়ুমণ্ডল কেও অনেকে থার্মোসিয়ারের অন্তর্ভুক্ত করেন তবে ওই অংশে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণতা বাড়েও না কমেও না একই রকম থাকে এই অংশকে সমতাঞ্চল বলা হয়।।
- নিম্ন থর্ম সিয়ার অঞ্চলে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন ওভাবে প্রাধান্য থাকে অবশ্য কিছু পরিমাণ অক্সিজেন পরমাণুর অস্তিত্ব থাকে।
- থার্মোস্ফিয়ারের নিম্ন অংশে সূর্য থেকে বিচ্যুরিত অতি বেগুনি রশ্মি থাকায় একে আয়ন মন্ডলও বলে।
- এই স্তর থেকে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে তাই আমরা রেডিও শুনতে পাই।
E. এক্সোস্ফিয়ার:
বায়ুমণ্ডলের উচ্চতম স্তর দুটির মধ্যে এটি অন্যতম। থার্মোস্ফিয়ার থেকে প্রায় 750 কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত যে বায়ুস্তর আছে তাকে এক্সোস্ফিয়ার বলে। আবার অনেকে এর বিস্তার 1000 কিলোমিটার পর্যন্ত চিহ্নিত করেন।
বৈশিষ্ট্য:
- এই স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে প্রায় 5568°C এ পৌঁছায়। তবে এই তাপমাত্রা ভিন্ন ধরনের এবং তা কখনো অনুভূত হয় না।
- এই স্তরে হিলিয়াম, হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রাধান্য দেখা যায়।
- বায়ুমণ্ডল কে এখানে অনেকটা নিহারিকার মতো মনে হয়।
- বায়ুমণ্ডলের এই স্তর থেকে গ্যাসীয় অণু-পরমাণু মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায় বলে এই স্তরকে এক্সোস্ফিয়ার বলে।
F. ম্যাগনেটোস্ফিয়ার:
এক্সোস্ফিয়ারের ওপরে বায়ুমন্ডলের শেষ সীমা কিংবা বিষম মন্ডলের সর্বশেষ সীমাকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বলে। এই স্তরের পরিসীমা প্রায় দশটি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান।
বৈশিষ্ট্য:
- ভূপৃষ্ঠ থেকে 750 থেকে 10,00০ কিলোমিটার পর্যন্ত এই স্তর বিস্তৃত।
- এখানে আণবিক অবস্থা যুক্ত ইলেকট্রন ও প্রোটন আয়ন গুলি বলয় আকারে অবস্থিত।
- এই স্তরে বায়ুমণ্ডলকে বেষ্টন করে একটি প্রোটন ও ইলেকট্রনের চুম্বকীয় ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়।
- ভূপৃষ্ঠ থেকে 3000 কিলোমিটার উচ্চতায় ভ্যান অ্যালেন বিকিরণ নামে দুটি বলয় আছে।