ভূমিকা:
পৃথিবীর সর্বত্র উত্তাপ সমান নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বায়ুমণ্ডলের উত্তাপের তারতম্য কতকগুলি নিয়ন্ত্রক দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই তারতম্যের নিয়ন্ত্রক গুলি হল –
1. অক্ষাংশ:
বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার পার্থক্যের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হল অক্ষাংশ। ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা নির্ভর করে সেই স্থানে আগত সূর্যরশ্মির পরিমাণের উপর এবং আগত সূর্যরশ্মির পরিমাণ সেই স্থানের অক্ষাংশের উপর নির্ভর করে। নিরক্ষরেখা থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে সূর্যরশ্মি ক্রমশ তির্যকভাবে পড়ে। লম্বভাবে পতিত সূর্যরশ্মির তুলনায় তির্যকভাবে পতিত সূর্যরশ্মতে উত্তাপের পরিমাণ কম হয়। এজন্য –
a. নিরক্ষরেখার উভয়দিকে সাড়ে 23° পর্যন্ত উষ্ণমণ্ডল।
b. সাড়ে 23° থেকে সাড়ে 66° পর্যন্ত নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল।
c. সাড়ে 66° থেকে 90° পর্যন্ত হিমমন্ডল।
এইভাবেই অক্ষাংশ অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
Read- সমুদ্রস্রোত কাকে বলে? মানবজীবনে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব লেখ।
2. উচ্চতা:
বায়ুমন্ডলের তাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হল উচ্চতা। সাধারণত এটি অক্ষাংশে অবস্থিত কোনো সমতল স্থলের তুলনায় উঁচু স্থানের তাপমাত্রা কম হয়। ট্রপোস্ফিয়ারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথেই 6.5°C/ Km হারে উষ্ণতা হ্রাস পায়। সেইজন্য একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও সমতল স্থানটির তুলনায় উঁচু স্থানের তাপমাত্রা কম হয়। যেমন – অধিক উচ্চতার কারণে নিরক্ষরেখায় অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো (5894 মিটার) পর্বতের উপর সারাবছর বরফ জমে থাকে।
3. পর্বতের অবস্থান:
পর্বতের অবস্থান বায়ুমণ্ডলের উত্তাপের একটি নিয়ন্ত্রক। উষ্ণ বা শীতল বায়ুর গতিপথে আড়াআড়িভাবে কোনো পর্বতশ্রেণী বিস্তৃত থাকলে বায়ুপ্রবাহ ওই পর্বতশ্রেণীতে বাধা পায়। ফলে পর্বতশ্রেণীর দুদিকের উষ্ণতার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।
4. সমুদ্র থেকে দূরত্ব:
উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে সামুদ্রিক আর্দ্র বায়ুর প্রভাবে জলবায়ু সমভাবাপন্ন প্রকৃতির হয়। আবার সমুদ্র থেকে মহাদেশের অভ্যন্তর ভাগের দূরত্ব যত বৃদ্ধি পায় জলবায়ু চরমভাবাপন্ন প্রকৃতির হয়। যেমন – সমুদ্র সংলগ্ন মুম্বাইয়ের গ্ৰীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা 33°C এবং সমুদ্র দূরবর্তী দিল্লির গ্ৰীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা 47°।
5. দিন-রাত্রির দের্ঘ্য:
দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্যের হ্রাস বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন স্থানের মধ্যে উষ্ণতার তারতম্য হয়, কারণ যদি দিন বড় ও রাত ছোটো হয় তাহলে দিনের বেলা ভূপৃষ্ঠে সঞ্চিত তাপের সম্পূর্ণটা রাতে বিকীর্ণ হতে পারে না,কিছুটা সঞ্চিত হয়ে থেকে যায়। কিছুদিন এক জায়গায় এরকম চললে স্বাভাবিক ভাবেই উষ্ণ হয়ে যায়। আবার দিন ছোটো ও রাত বড় হলে ভূপৃষ্ঠে সঞ্চিত তাপের সম্পূর্ণটাই রাতে বিকীর্ণ হয়ে যায়। ফলে কিছুদিন পরে সেখানে শীত অনুভূত হয়।
6. বায়ুপ্রবাহ:
বায়ুপ্রবাহ তাপের তারতম্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রক। বিভিন্ন ধরনের উষ্ণ ও শীতল বায়ু পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের উষ্ণতার পরিবর্তন ঘটায়। যেমন – ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু জুন মাসে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ মাত্র এখানকার উষ্ণতা 10°C কমে যায়।
7. সমুদ্রস্রোত:
উপকূল অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ ও শীতল স্রোত উপকূলের উষ্ণতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত যে কোনো দুটি স্থান একি অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও একটির পাশ দিয়ে যদি উষ্ণ স্রোত ও অপরটির পাশ দিয়ে যদি শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়, তাহলে প্রথম স্থানটির তাপমাত্রা উষ্ণ এবং দ্বিতীয় স্থানটির তাপমাত্রা শীতল হয়। যেমন – পেরু উপকূলে শীতল পেরু বা হামবোল্ড স্রোতের প্রভাবে সারা বছর উষ্ণতা কম হয়।
Read- হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।
8. মেঘাচ্ছন্নতা ও অধঃক্ষেপণ:
দিবাভাগে আকাশে মেঘ সৃষ্টি হলে সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। আবার রাতে মেঘাচ্ছন্নতা ভূপৃষ্ঠে পতিত সূর্যরশ্মির প্রতিফলনে বাধা দিয়ে উত্তাপ বাড়ায়। অধঃক্ষেপণ বায়ুমন্ডলের তাপ হ্রাস করে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাতের তুলনায় বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিপাতের তুলনায় শিলাবৃষ্টি আবার শিলাবৃষ্টির তুলনায় তুষারপাত অধিক মাত্রায় উত্তাপ কমায়।
9. ভূমির ঢাল:
সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা ভূমির ঢাল অধিক তাপ গ্ৰহণ করে। সূর্যের বিপরীত দিকের ভূমির ঢাল স্বল্প তাপ গ্ৰহণ করে। সূর্যের উত্তরায়নের সময় গোলার্ধে দক্ষিণমুখী ঢাল এবং দক্ষিণায়ণের সময় দক্ষিণ গোলার্ধের উত্তরমুখী ঢাল সূর্যের দিকে মুখ করে অবস্থান করে। তাই এই ঢালগুলি বেশি উত্তপ্ত হয়। অপরপক্ষে উত্তরায়ণে উত্তর গোলার্ধে উত্তরমুখী ঢাল এবং দক্ষিণায়ণের দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণমুখী ঢাল সূর্যের বিপরীত দিকে অবস্থান করে, তাই এই ঢালগুলি কম উত্তপ্ত হয়।
10. অরণ্য:
অরণ্যের ভিতর দিয়ে সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে বাধা পায় বলে ঘন অরণ্যের আশে পাশে বা ভেতরে বায়ুর উষ্ণতা কম হয়।
11. মৃত্তিকা:
বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকার তাপ গ্ৰহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা ভিন্ন বলে মৃত্তিকার তারতম্যে বিভিন্ন স্থানের উত্তাপের তারতম্য দেখা যায়। যেমন – ল্যাটেরাইট মাটির তাপ গ্ৰহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা বেশি। অন্য দিকে এঁটেল মাটির তাপ গ্ৰহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা কম।
Read- ইক্ষু উৎপাদনে অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশের বর্ণনা দাও।
This post was updated on 2023-02-22 17:58:05.