যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়াগুলি আলোচনা করো।

যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়াগুলি এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল।নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এখান থেকে 7মার্কস এর জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি লিখতে দিতে পারে আবার 5 মার্কস এর জন্য দুটি বা তিনটি প্রক্রিয়াও লিখতে দিতে পারে। কখনো কখনো 2 মার্কসের ও আসে। সুতরাং প্রশ্নটি তোমরা মনোযোগ সহকারে পড়ে পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো এবং বন্ধুদের সঙ্গেও শেয়ার করো।

   যান্ত্রিক আবহবিকার:        

                   উষ্ণতার পরিবর্তন, আর্দ্রতা ও শুষ্কতার পার্থক্য,শিলাস্তরে চাপের হ্রাস-বৃদ্ধি, তুষার ও লবণের কেলাস গঠন, জৈবিক কার্যাবলী ইত্যাদির প্রভাবে শিলার আবহবিকার ঘটলে অর্থাৎ শিলা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে।

যান্ত্রিক আবহবিকারের পদ্ধতিসমূহ:

যান্ত্রিক আবহবিকার পদ্ধতিসমূহ হল-

  • তাপমাত্রার পরিবর্তনজনিত যান্ত্রিক আবহবিকার।
  • কেলাসন প্রক্রিয়া।
  • শিলাস্তরের চাপ হ্রাস জনিত প্রক্রিয়া।
  • বৃষ্টিপাতের ক্রিয়া।
  • কলয়েড উৎপাটন।
  • কলিকরণ।

যান্ত্রিক আবহবিকারের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ:

A. তাপমাত্রার পরিবর্তনজনিত যান্ত্রিক আবহবিকার:

     1. প্রস্তর চাঁই খন্ডীকরণ:

                         শিলা চাপের কুপরিবাহী। দিনের বেলায় প্রবল উষ্ণতায় শিলার উপরিস্তর উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয় এবং রাত্রিবেলা তাপ বিকিরণের ফলে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু শিলার নিম্নস্তরে সংকোচন ও প্রসারণ হয় না। এভাবেই ক্রমাগত অসম সংকোচন ও প্রসারণের কারণে শিলাস্তরে পীড়নের সৃষ্টি হয় এবং পীড়নের নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে অসংখ্য উলম্ব ও সমান্তরাল ফাটলের সৃষ্টি হয়।একসময় এই ফাটল বরাবর বিভিন্ন আকৃতির শিলাখন্ড খুলে বেড়িয়ে আসে,একে প্রস্তর চাঁই খন্ডীকরণ (Block Disintegration) বলে। 
         
          মরু অঞ্চলে পাললিক শিলা ও ব্যাসল্ট শিলায় এই আবহবিকার অধিক হয়।


     2. ক্ষুদ্রকণা বিশরণ:

                         শিলা বিভিন্ন খনিজের সমন্বয়ে গঠিত।খনিজগুলির বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও রং ভিন্ন। ফলে দিনের বেলায় সূর্যের তাপে শিলা মধ্যস্থিত খনিজগুলি বিভিন্ন হারে প্রসারিত হয় এবং রাত্রিবেলা বিভিন্ন হারে সংকোচিত হয়।এরই ফলে শিলাস্তরের মধ্যে অসম সংকোচন ও প্রসারণের কারণে প্রবল পীড়নের সৃষ্টি হয়। এইভাবে, বারংবার অসম সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলাটি বিভিন্ন খনিজের সংযোগ বরাবর সশব্দে ফেটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ভেঙে যায়। এই প্রক্রিয়াকে ক্ষুদ্রকণা বিশরণ (Granular Disintegration) বলা হয়।
   
               থর, সাহারা, কালাহারি প্রভৃতি মরুভূমিতে সূর্যাস্তের পর প্রায়ই পিস্তলের গুলি ছোড়ার মতো শব্দ করে শিলা ফেটে যায়।

  

 Read- পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্পের সমস্যা আলোচনা করো।


 3. শল্কমোচন:

                    ‘শল্ক’ শব্দের অর্থ ‘পেঁয়াজের খোসা’ এবং ‘মোচন’ শব্দের অর্থ ‘ত্যাগ’। শিলার তাপ পরিবহন ক্ষমতা কম হওয়ায় দিনেরবেলা প্রখর সূর্যতাপে শিলার নীচের স্তরের তুলনায় উপরের স্তর খুব দ্রুত অধিক উষ্ণ ও প্রসারিত হয় এবং রাতে অধিক শীতল ও সংকুচিত হয়। দীর্ঘ দিন ধরে এভাবে সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলার উপরিস্তর আয়তনে বেড়ে যায় এবং নীচের স্তর থেকে উপরের স্তরটি পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে বেড়িয়ে আসে।এর ফলে, শিলার ভেতরের অংশটি কিছুটা গোলাকার মসৃণ শিলাখন্ডে পরিণত হয়।একে শল্কমোচন ( Exfoliation) বা গোলাকৃতি বিচূর্ণীভবন বলে।

                গ্ৰানাইট শিলায় এই আবহবিকার অধিক দেখা যায়।

    4. গন্ডশিলা বিদারণ:

                     অনেক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত শিলার মধ্যে থাকা কোনো বড়ো বোল্ডারের অর্ধেক অংশ ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত থাকলে ওই অংশ তাপের প্রভাবে ভেঙে গিয়ে ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এই পদ্ধতিকে গন্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving) বলা হয়। 

    5. ডার্ট ক্র্যাকিং:

                  শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যস্থিত পদার্থসমূহ সূর্যতাপে উত্তপ্ত ও প্রসারিত হলে ফাটল রেখা বরাবর শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়, একে ডার্ট ক্র্যাকিং (Dart Cracking) বলা হয়।

B. কেলাসন প্রক্রিয়া:

       1. তুহিন খন্ডীকরণ:

                        উচুঁ পর্বতের উপর বৃষ্টির জল শিলাস্তরে থাকা ফাটলের মধ্যে ঢুকে যায় এবং ঠান্ডায় জমে বরফে পরিণত হয়। জলের থেকে বরফের আয়তন বেশি হয়।এর ফলে ফাটলের দুপাশের দেওয়ালে প্রচণ্ড চাপ পড়ে।এই চাপের প্রভাবে ফাটল ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।শেষে শিলাস্তর ফেটে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোণযুক্ত শিলাখন্ডের সৃষ্টি হয় এবং পর্বতের পাদদেশে নুড়ির ক্ষেত্র তৈরি করে।একে তুহিন খন্ডীকরণ বলে।
        
             এই প্রস্তরখন্ডগুলি পর্বতের পাদদেশ বরাবর সমান্তরালভাবে জমা হলে, তাকে ফেলসেনমার বা ব্লকস্পেড বলা হয়।
         আবার, এই প্রস্তরখন্ডগুলি পর্বতের গা বরাবর উপর নীচে অর্থাৎ উল্লম্বভাবে সঞ্চিত হলে, তাকে স্ক্রি বা ট্যালাস বলে।

      2. লবণ কেলাস গঠন:

                       শুষ্ক অঞ্চলে বিশেষত উষ্ণ মরু অঞ্চলে ভূমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ থাকে।স্বল্প বৃষ্টিপাতের সময় ঐ লবণ ধৌত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিলাস্তরে প্রবেশ করে।পরে অত্যধিক উষ্ণতায় বাষ্পীভবন ঘটলে শিলাস্তরের এই দ্রবীভূত লবণ কেলাসিত লবণে রূপান্তরিত হয়ে প্রবল চাপে শিলার বিচূর্ণীভবন ঘটায়।এই প্রক্রিয়াকে লবণ কেলাস গঠন বলা হয়।
                
                 প্রধানত শুষ্ক অঞ্চলে বেলেপাথরে এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়।

C. শিলাস্তরের চাপ হ্রাস জনিত প্রক্রিয়া:

                       শিলার উপরের চাপ হ্রাস পেলে শিলা প্রসারিত হয় এবং ফেটে যায়। কোনো শিলার ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল ফাটলের মাধ্যমে পাতলা পাতলা পাতের আকারে ভেঙে যাওয়াকে শিটিং( Sheeting) বলে।পাতলা পাতের পরিবর্তে টুকরো টুকরো খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়াকে স্প্যালিং(Spalling) বলে।

D. বৃষ্টিপাতের ক্রিয়া:

                    বৃষ্টিপাতের ফলে বিভিন্নভাবে যান্ত্রিক আবহবিকার হয়ে থাকে।যথা-
  1. জলস্রোতের ফলে সৃষ্ট বুদবুদের বায়ু শিলাফাটলে প্রবল চাপের সৃষ্টি করে এবং শিলায় আবহবিকার ঘটায়।
  2. শিলাছিদ্রে সঞ্চিত জল গ্ৰীষ্মকালে শুকিয়ে যায় এবং আর্দ্র সময়ে জলপূর্ণ হয়। ক্রমাগত আর্দ্রতা ও শুষ্কতার কারণে শিলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
  3. মরু অঞ্চলে অতি উত্তপ্ত শিলার উপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে শিলা সংকুচিত হয় ও ফেটে যায়। 

E. কলয়েড উৎপাটন:

                     ‘কলয়েড’ শব্দের অর্থ ‘আঠা’। খনিজ ও জৈব সংমিশ্রণে সৃষ্ট মাটির একপ্রকার আঠালো উপাদান হল কলয়েড। শিলাস্তরের উপর আর্দ্র মৃত্তিকা কণা সঞ্চিত হলে তা যখন শুকিয়ে যায়,মূল শিলা থেকে ক্ষুদ্র কণা উৎপাটন করে একে কলয়েড উৎপাটন বলা হয়।

F. কলিকরণ:

                 সমুদ্র উপকূল বরাবর পর্যায়ক্রমে জোয়ার ভাটা বা সমুদ্র তরঙ্গের প্রভাবে শিলা আর্দ্র এবং সূর্য তাপে শুষ্ক হয়। ফলে শিলাস্তরের অসম টান ও পীড়নের সৃষ্টি হয় এবং শিলা ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।এই প্রক্রিয়াকে কলিকরণ(Slaking)বলে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!