ভূমিকা:
হিমবাহের ক্ষয়কার্য শুধুমাত্র উঁচু পর্বতের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে এবং এই ক্ষয়কার্যের ফলে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় –
1. করি বা সার্ক:
উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ ও তার সাথে বাহিত শিলা খন্ডের উৎপাটন ও অবঘর্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হিমবাহ উপত্যকার একদিকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খুব খাড়া ও মধ্যবর্তী অংশ গর্তের ফলে গভীর হয়ে অনেকটা হাতলযুক্ত ডেকচেয়ার বা অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো ভূমিরূপ গঠন করে। এই ধরনের ভূমিরূপকে ইংল্যান্ডে করি এবং ফ্রান্সে সার্ক বলে।
একটি করির তিনটি অংশ দেখা যায়। যথা –
- মাথার দিকে খাড়া প্রাচীর।
- উচুঁ প্রান্তভাগ বা বেসিনের কানা।
- সার্কের বিপরীতমুখী ঢালযুক্ত বেসিন।
যেমন – আন্টার্কটিকার ওয়ালকট সার্ক পৃথিবীর বৃহত্তম সার্ক (16 কিমি চওড়া, 3000 মিটার উচ্চ)।
2. করি হ্রদ:
হিমবাহ সৃষ্ট করির মধ্যবর্তী খাতটিতে অনেক সময় অবশিষ্ট অংশ হিসেবে হিমবাহ থেকে যায়। পরবর্তীতে হিমবাহ গলে গিয়ে হ্রদের সৃষ্টি করে একে করি হ্রদ বলে।
3. এরিটি বা অ্যারেট:
পর্বত শিখর থেকে পাশাপাশি দুটি হিমবাহ প্রবাহিত হলে উৎপাটন ও অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় সার্ক দুটি বাড়তে থাকে। সার্ক গঠনের প্রায় শেষ পর্যায়ে দুটি সার্কের মাঝে একটি সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ম প্রাচীর অবস্থান করে। একে এরিটি বা অ্যারেট বলে।
যেমন – হিমালয় এবং কারাকোরাম পার্বত্য অঞ্চলে অনেক এরিটি দেখা যায়।
Read- উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল বা ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের বিবরণ দাও
4. পিরামিড চূড়া বা হর্ণ:
উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে কয়েকটি এরিটির বিপরীতমুখী অবস্থানের ফলে মধ্যবর্তী শৃঙ্গটিকে পিরামিডের মতো দেখায় , একে পিরামিড চূড়া বা হর্ণ বলে।
যেমন – সুইজারল্যান্ডের ম্যাটারহর্ণ একটি বিখ্যাত পিরামিড চূড়া।
5. ‘U’ আকৃতি বিশিষ্ট হিমবাহ উপত্যকা:
পার্বত্য অঞ্চলে নদী উপত্যকার মধ্য দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হলে হিমবাহের পার্শ্বক্ষয় ও নিম্নক্ষয় প্রায় সমানভাবে হয় বলে সেই উপত্যকাটির আকৃতি ইংরেজি ‘U’ অক্ষরের মতো হয়। একে তাই ‘U’ আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণী বলা হয়।
যেমন – নয়ওয়ে, গ্ৰিনল্যান্ড প্রভৃতি জায়গায় ‘U’ আকৃতির উপত্যকা দেখা যায়।
6. হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান:
হিমবাহ অধ্যুষিত অঞ্চলে অসম ক্ষয় কার্যের ফলে উপত্যকা বরাবর সিঁড়ি বা ধাপের সৃষ্টি হয়।একেই হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান বলে।
হামসিঁড়িতে বরফ গলা জল জমে হ্রদ সৃষ্টি হলে তাকে প্যাটার্নস্টার হ্রদ বলে।
7. ঝুলন্ত উপত্যকা:
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক সময় প্রধান হিমবাহের সাথে ছোটো ছোটো হিমবাহ এসে মিলিত হয়। প্রধান হিমবাহের আয়তন ও গভীরতা অধিক হওয়ায় এর দ্বারা সৃষ্ট উপত্যকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপ হিমবাহ সৃষ্ট উপত্যকা অপেক্ষা বেশি গভীর হয়। এরূপ অবস্থায় ক্ষুদ্রাকার হিমবাহ উপত্যকা যেন প্রধান হিমবাহ উপত্যকার উপর ঝুলন্ত অবস্থায় আছে বলে মনে হয়, একেই ঝুলন্ত উপত্যকা বলে।
যেমন – হিমালয় পর্বতের বদ্রীনাথের নিকট কুবের পর্বতশৃঙ্গের কাছে এরূপ উপত্যকা দেখা যায়।
8. কর্তিত শৈলশিরা বা কর্তিত স্পার:
কোনো পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় হিমবাহ সেই উপত্যকার দুপাশে অবস্থিত পর্বত শৃঙ্গের পাদদেশীয় বা প্রসারিত অংশ গুলিকে ক্ষয় করে এগিয়ে যেতে থাকে।এর ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত, প্রসারিত পার্বত্য অংশগুলি ত্রিভুজ আকৃতির যে শৈলশিরা সৃষ্টি করে তাকেই বলে কর্তিত শৈলশিরা বা কর্তিত স্পার।
9. রসেমতানে:
হিমবাহের প্রবহপথে কোনো কঠিন শিলা খন্ড ঢিবির আকার উঁচু হয়ে থাকলে, ক্ষয়কার্যের ফলে হিমবাহের প্রবাহের দিকে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় শিলাখন্ডটি মসৃণ ও বিপরীত দিকে উৎপাটন প্রক্রিয়ায় এবড়ো খেবড়ো বা অসমতল হয়। এরূপ ভূমিরূপকে রসেমতানে বলে।
যেমন – কাশ্মীরে লিডার নদী উপত্যকায় এরূপ ভূমিরূপ দেখা যায়।
10. ফিয়র্ড:
উচ্চ অক্ষাংশের সমুদ্র উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে হিমবাহ উপত্যকা ক্রমশ গভীর হতে হতে যদি উপকূলে নিমজ্জিত হয় তাহলে ঐ উপত্যকার বিস্তীর্ণ অংশ জলমগ্ন হয়ে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় তাকে ফিয়র্ড বলে।
যেমন – পৃথিবীর গভীরতম ফিয়র্ড হল নয়ওয়ের সোংনে।
11. ক্রাগ ও টেল:
হিমবাহের গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলা পরপর থাকলে অনেক সময় কঠিন শিলা কোমল শিলাকে হিমবাহের ক্ষয়কার্য থেকে কিছুটা রক্ষার করে। কোমল শিলা গঠিত অংশ তখন কঠিন শিলার পেছনে লেজের মতো বিস্তৃত থাকে একে টেল বলে এবং এবড়ো খেবড়ো অংশকে বলা হয় ক্র্যাগ।
যেমন – স্কটল্যান্ডের মিডল্যান্ড উপত্যকায় এটি দেখা যায়।
12. হোয়েল ব্যাংক:
হিমবাহের ক্ষয়ের ফলে হিমবাহের গতিপথে অবস্থিত কোন সমসত্ব শিলার দুদিক মসৃণ হয়ে যে দুদিক খাড়া ঢিবির সৃষ্টি হয় তাকে হোয়েল ব্যাক বলে।
This post was updated on 2023-02-22 17:58:23.