বর্জ্যের প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ, বর্জ্য পদার্থকে কিভাবে সম্পদে পরিণত করা যায়, বর্জ্য পদার্থ থেকে কী কী সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আশা করি এগুলি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। তোমরা নিজেরা মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং প্রশ্নগুলো তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।
বর্জ্যের প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ:
প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে বর্জ্য পদার্থকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় –
1. কঠিন বর্জ্য:
যেসব বর্জ্য পদার্থ জলে সহজে দ্রবীভূত হয় না বা মিশে যায় না এবং যাদের জল ব্যতীত অন্য উপায়ে সংগ্রহ করা যায় তাদের কঠিন বর্জ্য পদার্থ বলে। কঠিন বর্জ্য পদার্থ প্রধানত গার্হস্থ আবর্জনা, শিল্পজাত আবর্জনা ও নির্মাণ কার্যে ব্যবহৃত আবর্জনা।
2. তরল বর্জ্য:
স্নান ঘরের ব্যবহৃত জল, রান্নাঘরের থালাবাসন ধোয়া জল, জামাকাপড় কাচা জল, মল-মূত্র, শিল্প ও কারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন রাসায়নিক ক্ষতিকারক উপাদান, কসাইখানার ড্রেন থেকে নির্গত রক্ত, রক্তরস প্রভৃতি পদার্থকে তরল বর্জ্য বলা হয়।
3. গ্যাসীয় বর্জ্য:
বিভিন্ন কলকারখানা, মোটরগাড়ি প্রভৃতি থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস, যেমন – সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, প্রাণীর মলমূত্র থেকে উৎপন্ন গ্যাস, রান্নার ধোঁয়া, সুগন্ধি স্প্রে কে বলা হয় গ্যাসীয় বর্জ্য।
এছাড়া আরো দুই প্রকার বর্জ্য আছে। যথা –
a. বিষাক্ত বর্জ্য:
জীব অবিশ্লেষ্য সমস্ত বর্জ্য পদার্থই বিষাক্ত। যেসব বর্জ্য পদার্থ থেকে মানুষ ও জীবদেহে বিষক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে তাকে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ বলে।
যেমন – কৃষিকাজের ব্যবহৃত কীটনাশক ঔষধসমূহ, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সমূহ, এছাড়া কলকারখানা ও মোটরগাড়ি থেকে নির্গত কার্বন, সালফার, নাইট্রোজেনের অক্সাইড সমূহ।
b. বিষহীন বর্জ্য:
অধিকাংশ জীব বিশ্লেষ্য পদার্থই বিষহীন বর্জ্য আবার অধিকাংশ জীববিশ্লেষ্য পদার্থকে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিষহীন পদার্থে পরিণত করা যায়।
উৎস: গৃহস্থালির বর্জ্য মূলত গৃহস্থালির বর্জ্য সমূহ এবং অফিসের বর্জ্য সমূহ।
বর্জ্য পদার্থকে সম্পদে পরিণত করার পদ্ধতি:
মানুষের উন্নত চিন্তাভাবনা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা যায়। যেমন –
1. পুনঃব্যবহার:
বাড়ির পুরনো কাগজ, ছেড়া কাপড়, বাতিল পদার্থ দিয়ে নতুন নতুন ঘর সাজানোর বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করা যায়।
যেমন – চিনিকলে প্রচুর পরিমাণ আগের ছিবড়ে বা ব্যাগাসে পাওয়া যায় তাই দিয়ে কাগজ তৈরি করা যায়।
2. পুনঃচক্রীকরণ:
ভাঙা কাঁচ, পুরনো কাগজ, টায়ার, প্লাস্টিক প্রভৃতি দ্রব্য থেকে যথাক্রমে নতুন কাঁচ, নতুন কাগজ, নতুন টায়ার, প্লাস্টিক প্রভৃতি তৈরি করা যায়। তাই বর্জ্য বস্তুকে বাছাই করে তাকে পুনঃচক্রীকরণ ব্যবহার করতে হবে। এতে বর্জ্যের পরিমাণ যেমন কমবে তেমনি সম্পদের ব্যবহার বাড়বে।
3. সার উৎপাদন:
জীব বিশ্লেষণ পৌর আবর্জনা থেকে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল্ড বা সম্ভাব্য পদ্ধতি প্রয়োগ করে দুই থেকে চার মাসের মধ্যে জৈব সার উৎপাদন করা হয় যা কৃষি ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগে।
4. নীচু জমি ভরাটকরণ:
কোনো নীচু জমিকে ভরাট করতে বর্জ্যের প্রয়োজন হয়। এতে খরচও কমে আবার হিসেবেও প্রমাণিত হয়। যেমন – তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই জমি ভরাটাই খুব কাজে লাগে।
5. রাস্তাতৈরি:
বর্তমানে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই ও জীব অবিশ্লেষ্য পদার্থ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়। এতে বর্জ্যের পরিমাণ যেমন কমছে তেমনি বর্জ্যের ব্যবহারও বাড়ছে।
6. জ্বালানি:
পয়ঃপ্রণালীর মল-মূত্র, গোবর, পৌর আবর্জনা, শুকনো পাতা প্রভৃতি থেকে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। যা জ্বালানি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বর্জ্য পদার্থ থেকে সৃষ্ট সমস্যা:
1. চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য থেকে সৃষ্ট সমস্যা:
হাসপাতাল, নার্সিংহোম, প্যাথলজিক্যাল, ল্যাবরেটরি প্রভৃতি স্থান থেকে নির্গত বর্জ্যে নানা ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। টিটেনাস, কৃমি, আমাশয়, হেপাটাইটিস, চামড়ার রোগ, এইডস, ফুসফুসের ইত্যাদি বিভিন্ন সংক্রমণ হতে পারে।
2. কৃষিক্ষেত্রের বর্জ্য থেকে সৃষ্ট সমস্যা:
কৃষিক্ষেত্রের আবর্জনা কৃষিক্ষেত্রের বাস্তুতন্ত্র কে নষ্ট করে দিতে পারে। জমিতে প্লাস্টিক পড়ে থাকলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কৃষি ক্ষেত্র থেকে কৃমি, আমাশয়, ফুসফুসের রোগ, পেটের রোগ ও নানান ধরনের রোগ ব্যাধি ঘটতে পারে।
3. কলকারখানার বর্জ্য থেকে সৃষ্ট সমস্যা:
কলকারখানার তরল বর্জ্য নিকটবর্তী নদী, খালে পড়লে ওই জল সম্পূর্ণরূপে দূষিত হয়। এতে জলজ প্রাণীদের মৃত্যু হয় এবং জলজ উদ্ভিদের ক্ষতি হয়। কলকারখানার বর্জ্য থেকে নিকটবর্তী অঞ্চলের মাটি দূষিত হয় ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।
4. নির্মাণ শিল্পের বর্জ্য থেকে সৃষ্ট সমস্যা:
সিমেন্ট, বালি বায়ুদূষণ ঘটায়, মাটির উৎপাদন ক্ষমতা একেবারে কমিয়ে দেয়, শ্রমিকদের ফুসফুসের রোগ ও পেটের রোগ বেড়ে যায়।
5. তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের দূষণ:
তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণে মাটি সর্বাধিক দূষিত হয়। এই বর্জ্য পৃথিবীর সর্বাধিক ক্ষতিকারক বর্জ্য। ভৌম জল পানের অযোগ্য হয়, প্রাণী ও উদ্ভিদের জিনগত পরিবর্তন হয়। তেজস্ক্রিয় দূষণের পকৃষ্ট উদাহরণ ইউক্রেনের চেরনোবিল অঞ্চল।
FAQ/বহুচর্চিত প্রশ্নাবলী
লিচেট কাকে বলে?
বৃষ্টির জল ল্যান্ডফিলের বর্জ্য পদার্থ ধুয়ে জলাশয়ে বা ভৌমজলে মেশে। এইসব বর্জ্য-ময়লা ধোয়া জলকে লিচেট বলে। লিচেট জল ভৌম জলকে দূষিত করে, নদী, পুকুরের জলও দূষিত হয়।
স্ক্রাবার কী?
বাংলায় স্ক্রাবারকে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের সিক্ত পদ্ধতি বলে। বস্তুকনা, বিস্তৃত বায়ু বা গ্যাসকে জলে ধোয়া যন্ত্রের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়। ফলে বস্তুকণা জলে মিশে ভারী হয়ে পাত্রের নীচে থিতিয়ে পড়ে এবং পরিষ্কার বাতাস বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। এই পদ্ধতি স্ক্রাবার নামে পরিচিত। স্ক্রাবারে রাখা জল ও কলিচুনের মধ্য দিয়ে বায়ু চালনা করার সময় বস্তুকণা 99% শোষিত হয়। এই দূষিত বাতাস স্ক্রাবারের মাধ্যমে পরিস্রুত হয়ে পরিষ্কার বাতাস নির্গত হয়। একে গ্যাস স্ক্রাবার বলা হয়।