গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জলনির্গম প্রণালীর শ্রেণিবিন্যাস কর।

গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জলনির্গম প্রণালীর শ্রেণিবিন্যাস এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আশা করি এগুলি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। তোমরা নিজেরা মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং প্রশ্নগুলো তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।

ভূমিকা:

ভূতাত্ত্বিক তথা শিলার গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে সরল ও জটিল অনেক ধরনের নদী নকশা সৃষ্টি হয়। এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হল –

1. বৃক্ষরূপী নদী নকশা:

গ্ৰিক শব্দ ‘Dendron’ থেকে ‘Dendritic’ কথাটি এসেছে। আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক নদী বিন্যাস বলতে বৃক্ষরূপী নদী বিন্যাস বোঝায়। এই বিন্যাসের বিবর্তনে এককভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায় না। শিলা স্তর ও ভূগঠন প্রতিটি ক্ষেত্রে সমানভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এইধরনের নদীবিন্যাসে বহু নদীর মিলনের ফলে অনেকটা ডালপালা যুক্ত নদীপ্রণালী সৃষ্টি হয় বলে একে বৃক্ষরূপী নদীবিন্যাস বলে।

যেমন – ভারতের গোদাবরী অববাহিকায় এই ধরনের নদী বিন্যাস শিক্ষকরা যায়।

বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালীর দুটি পরিবর্তিত রূপ লক্ষ করা হয় – a. উপবৃক্ষরূপী নদী নকশা, b. চুনট বা পিনেট নদী নকশা।

a. উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা:

বৃক্ষরূপী নদী নকশার একটি পরিবর্তিত রূপ হল উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা বলে। বৃক্ষরূপী নকশাটি বেশ লম্বাটে ধরনের হলে তাকে উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা বলে। উপনদী গুলি আরও বেশি সূক্ষ্মকোণে প্রধান নদী বা অনুগামী নদীর সঙ্গে মিলিত হলে এই ধরনের নদী নকশা সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ – মৃদু হেলানো উপকূলীয় সমভূমি এবং হিমবাহ দ্বারা সৃষ্ট টিল সমভূমিতে উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা দেখা যায়।

b. চুনট বা পিনেট নদী নকশা:

‘Pinnate’ কথাটির অর্থ ‘যৌগিক পাতা’ এটিও বৃক্ষরূপী নদী নকশার এক পরিবর্তিত রূপ। অনেকটা বৃক্ষরূপী দলনির্গম প্রণালীর মতো, কিন্তু একটু পৃথক ধরনের জলনির্গম প্রণালী হল পিনেট। এই জলনির্গম প্রণালীতে উপনদী গুলির দৈর্ঘ্য খুবই ছোটো এবং সেগুলি প্রধান নদীতে সূক্ষ্মকোণে এসে পড়ে। এই জলনির্গম প্রণালীতে প্রধান নদী ও উপনদী গুলির বিন্যাস যৌগিক পাতার মতো হয় বলে একে পিনেট বলে।

তীব্র ঢাল বিশিষ্ট সংকীর্ণ নদীর উপত্যকায়, যেমন – নর্মদা নদী উপত্যকায় এরূপ জন প্রণালী দেখা যায়।

2. সমান্তরাল নদী নকশা:

মাঝারি থেকে খাড়া ঢালু ভূপৃষ্ঠে সাধারণত পাশাপাশি অনেকগুলি অনুগামী নদীখাত সৃষ্টি হয়। খাড়া ঢাল হেতু নদীগুলি সরলরেখার মত পরস্পরের সমান্তরালে একই দিকে নীচের দিকে প্রবাহিত হয়। তাই এই জাতীয় নদীবিন্যাসকে সমান্তরাল নদী-বিন্যাস বলে। উপনদী রূপে এই নদীগুলি এক বা একাধিক প্রধান নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এই ধরনের নদী নকশা নদী বিবর্তনের প্রারম্ভিক বা প্রাথমিক অবস্থাকে নির্দেশ করে।

উদাহরণ – বিন্ধ্যের ভৃগুঢাল, পশ্চিম উপকূলের তটভূমি, মেসা ভার্দে ন্যাশনাল পার্ক প্রভৃতি জায়গায় দেখা যায়।

3. জাফরিরূপী নদী নকশা:

‘Trellis’ কথার অর্থ গাছে ওঠার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী দন্ড বা ‘জাফরি’। সাধারণত অধিক বৃষ্টিপাত, ঘনচ্যুতি রেখা এবং অত্যাধিক ফাটল যুক্ত অঞ্চলে এই প্রকার জননির্গম প্রণালী সৃষ্টি হয়। ভূপৃষ্ঠের যে অংশে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর পাশাপাশি অবস্থান করে সেখানে পরবর্তী নদী এবং বিপরা নদীগুলি কঠিন শিলাস্তর এড়িয়ে কোমল শিলাস্তরের আয়াম বরাবর পরস্পর সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে অনুগামী নদীর সঙ্গে সমকোণে মিলিত হয়। এই অঞ্চলের নদীগুলি বহুদূর বয়ে এসে পরস্পর সমকোণে মিলিত হয় বলে এদের প্রবাহপথ মোটামুটি সমান্তরাল। এখানে অনুগামী নদী, পরবর্তী নদী, বিপরা নদী ইত্যাদির সমন্বয়ে ভূপৃষ্ঠের উপর যে নকশা বা ছাঁচের সৃষ্টি হয় তা অনেকটা জাফরির মতো আকৃতির হয়, তাই একে জাফরি জলনির্গম প্রণালী বলে।

দ্রাক্ষাক্ষেত্রে দ্রাক্ষালতার মূল কান্ড থেকে বেরিয়ে আসা ডালগুলি জাফরির উপর যেরকম ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তার সাথে এই জলনির্গম প্রণালীর সাদৃশ্য থাকায় একে Grape vine drainage বলে।

কখনো কখনো শিলাস্তরে ফাটল ও চ্যুতির ঘনত্ব কম থাকলে জাফরিরূপী নদীবিন্যাস বিকাশ লাভ করতে পারে না, সে ক্ষেত্রে উপজাফরিরূপী নদীবিন্যাস সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ – আরাবল্লী পার্বত্য অঞ্চল, অসমের কাছাড় এলাকা, দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চল প্রভৃতি এলাকায় দেখা যায়।

4. আয়তাকার নদী নকশা:

মধ্যম বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে এই প্রকার জলনির্গম প্রণালীর উদ্ভব ঘটে। এই জাতীয় নদী বিন্যাসে নদীর ঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে নদীর দৈর্ঘ্য কম থাকে। সমগ্র অঞ্চলটিতে উপনদী গুলি নানা দিক থেকে এসে মূল নদীর সঙ্গে সমকোণে মিলিত হয়, ফলে এই অঞ্চলের নদীগুলিকে আয়তকারে বিন্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তাই এই প্রকার জলনির্গম প্রণালী আয়তাকার জলনির্গম প্রণালী নামে পরিচিত। স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে চ্যুতি ও ফাটলের উপস্থিতির দরুন এরূপ জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে।

উদাহরণ – আরাবল্লী পর্বতের পশ্চিমাংশে এই নদীর নকশা খুব ভালোভাবে গঠিত হয়েছে।

5. কৌণিক নদী নকশা:

আয়তাকার জলনির্গম প্রণালীর একটি বিশেষ ভঙ্গি বা পরিবর্তিত রূপ হল কৌণিক জলনির্গম প্রণালী। এই প্রকার নদী বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য হল – এখানকার উপনদীগুলি প্রধান নদীর সঙ্গে চ্যুতি বরাবর সমকোণে মিলিত না হয়ে সূক্ষ্মকোণ বা স্থূলকোণে মিলিত হয়। নদী অববাহিকার শিলা স্তরে চ্যুতি ও দারণের জন্য সূক্ষ্ম বা স্থূলকোণ সৃষ্টি হলে এই প্রকার জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে।

উদাহরণ – আফ্রিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে এই প্রকার জলনির্গম প্রণালী দেখা যায়।

6. কেন্দ্রমুখী নদী নকশা:

কোনো নিম্ন বা অবনমিত অঞ্চলে বা কোনো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে এই ধরনের নদী বিন্যাস গড়ে ওঠে, আবার কোনো হ্রদের চারপাশের জমি যদি হ্রদের দিকে ঢালু থাকে সেক্ষেত্রেও এই ধরনের নদী বিন্যাস সৃষ্টি হয়। এরূপ নদী বিন্যাসের নদীগুলি একটি কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। এই জন্য এইরূপ নদীবিন্যাসকে কেন্দ্রমুখী নদী বিন্যাস বলে।

উদাহরণ – ভারতের দুন অঞ্চল এবং নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকায় এরূপ নদী বিন্যাস লক্ষ করা যায়।

7. কেন্দ্রবিমুখ নদী নকশা:

যে অঞ্চলের ভূমিরূপের আকৃতি অনেকটা টিলা বা গম্বুজের মতো সেখানে এইধরনের নদী বিন্যাস গড়ে ওঠে। নদীগুলি একটি চূড়া থেকে চক্রাকারে বাইরের দিকে প্রবাহিত হয়। নদীগুলি যতই প্রসারিত হতে থাকে ততই এরা কেন্দ্র থেকে দূরে সরতে থাকে।

উদাহরণ – ঝাড়খণ্ডের পরেশনাথ পাহাড়ে এই ধরনের নদী বিন্যাস লক্ষ করা যায়।

8. অঙ্গুরীয়াকার নদী নকশা:

‘Annular’ কথার অর্থ ‘আংটির মতো’। কখনো কখনো গম্বুজাকৃতির ভূমিরূপ এর মধ্যে শিলাস্তরের বিষম কাঠিন্য লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে নদীগুলি অঙ্গুরীয় বা আংটির মতো গোলাকার পথে প্রবাহিত হয়। এই জন্য এই জাতীয় নদী বিন্যাসকে অঙ্গুরীয় আকৃতির নদী বিন্যাস বলে। সাধারণত কোনো গম্বুজাকৃতির পর্বতে নরম ও শক্ত শিলাস্তর পরপর অবস্থান করলে আবহবিকারের কারণে নরম শিলা তাড়াতাড়ি ক্ষয় হয়ে যায় এবং শক্ত শিলা ক্ষয় প্রতিরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শক্তশিলার মাঝে অবস্থিত নরম শিলার উপর এই জাতীয় নদী-বিন্যাসের সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ – যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ডাকোটায় রেড নদী ব্ল্যাক হিল পাহাড়কে বেষ্টন করে এরূপ নদী নকশা তৈরি করে প্রবাহিত হচ্ছে।

9. বরশি বা আঁকশিরূপী নদী নকশা:

সাধারণত নদী উৎস অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে এই ধরনের নদী বিন্যাস গড়ে ওঠে। এরূপ নদী বিন্যাস সাধারণত নদী গ্রাসের ফলে সৃষ্টি হয়। এই জল নির্গম প্রণালীর উপনদী গুলি নৌকা ঠেলবার লোহার আঁকশির মতো বেঁকে সূক্ষ্ম বা স্থূলকোণে প্রধান নদীর সাথে মিলিত হয়। নদীগ্রাসের ফলে পার্শ্ববর্তী পৃথক এক নদী গোষ্ঠীর কিছু অংশ উল্টে-পাল্টে যায়। এই ধরনের জলনির্গম প্রণালীতে বিভিন্ন নদীর সাথে অভ্যন্তরীণ গঠনের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না তাই একে অসংগত জলনির্গম প্রণালী বলে।

উদাহরণ – বিহারের সিংভূম জেলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে সারান্ডা পাহাড় অঞ্চলে দক্ষিণ কোয়েল নদীর সঙ্গে কারো নদীর উত্তল বাঁক নিয়ে মিলনে এরকম নদীবিন্যাস তৈরি হয়েছে।

10. বিনুনী আকৃতির নদী নকশা:

নদী যখন পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে সমভূমিতে নামে তখন ঢালের পরিবর্তনের জন্য পাহাড় থেকে আনা দ্রব্য গুলি নদীগর্ভে জমা করে। ফলে নদীগর্ভ ভরাট হয়ে গিয়ে নদীর জল ধরনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন নদী বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে কিছু দূরে এগোবার পর আবার মিলিত হয়ে পুনরায় আলাদা আলাদা হয়ে যায়। এভাবে প্রবাহিত নদীগুলিকে অনেকটা বিনুনীর মতো দেখায়, তাই এই ধরনের নদীবিন্যাসকে বিনুনী আকৃতির নদী-বিন্যাস বলে।

উদাহরণ – উত্তরবঙ্গে হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলে তিস্তা, মহানন্দা, জলঢাকা, তোর্সা ইত্যাদি নদীগুলি সৃষ্টি করেছে।নদী যেখানে সাগরে মেশে সেখানেও নদীতে চড়া সৃষ্টি হয়ে এই ধরনের জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে।

11. জটাজালরূপী নদী নকশা:

ইংরেজি Anastomosing কথাটি এই ধরনের জলনির্গম প্রণালীর যথার্থ রূপ প্রকাশ করে। এই কথাটির অর্থ cross connection of arteries, rivers etc. অর্থাৎ নদীপ্রবাহ জটাজাল। কোনো নদীর জলপ্রবাহ জটাজালের মতো কখনো বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে বা কখনো সেগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রবাহিত হলে তাকে জটাজাল রূপী নদী নকশা বলে।

উদাহরণ – এরূপ জলনির্গম প্রণালীভঙ্গি প্রধানত বদ্বীপ অঞ্চলে দেখা যায়, যেখানে ভূমির ঢাল প্রায় থাকে না বললেই চলে।

FAQ/বহুচর্চিত প্রশ্নাবলী

হেরিংবোন নদী নকশা বলতে কী বোঝো?

প্রায় সরলরেখায় প্রবাহিত প্রধান নদীর সঙ্গে দু’পাশের উপনদীগুলিও প্রায়ই সরলরেখায় প্রবাহিত হয়ে প্রধান নদীতে মিশে যে নদী নকশা ফুটে ওঠে তাদের সাথে হেরিং মাছের কাঁটার অনেক সাদৃশ্য থাকায় একে হেরিংবোন নদী নকশা বলে।
উদাহরণ – কাশ্মীর উপত্যকায় ঝিলাম নদীর ঊর্ধ্ব প্রবাহ পথে এই ধরনের জলনির্গম প্রণালী দেখা যায়।

পর্যায়িত নদী কি?

W.D.Thornbury এর মতে পর্যায়িতা নদী হল এমন এক নদী যার ক্ষয় ও সঞ্চয় করার ক্ষমতা নেই, কেবলমাত্র ক্ষয়িত দ্রব্য গুলি বহন করে দ্রুত সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত করে। যদি কোনো নদী ক্ষয় বা সঞ্চয় কোনোটিই না করে ক্ষয়িত দ্রব্যগুলি সঙ্গে নিয়ে চলে তবে নদীগুলিকে পর্যায়িত নদী বলে। বাস্তবে এই ধরনের নদী নেই বললেই চলে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!