সবুজ বিপ্লব কি এবং সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে বিস্তারিত এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আশা করি এগুলি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। এটি 7 মার্কসের প্রশ্ন হিসেবে আসতে পারে আবার সবুজ বিপ্লবের সুবিধা ও অসুবিধা 5 মার্কেসেরও আসে। তোমরা নিজেরা মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং প্রশ্নগুলো তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো। তোমরা তোমাদের প্রয়োজনীয় প্রশ্ন কমেন্ট করে জানাতে পারো।

সবুজ বিপ্লব:
উচ্চফলনশীল বীজ ও অন্যান্য আধুনিক কৃষি পরিকাঠামো, যেমন – জলসেচের বিস্তার, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও অন্যান্য বিভিন্ন অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এর সাহায্যে ১৯৬০ এর দশকে ভারতে কৃষিজ ফসলের উৎপাদনে যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল, তাকে সবুজ বিপ্লব বলে। সবুজ বিপ্লবকে ইংরেজি পরিভাষায় ‘Green Revolution’ বলে।
মেক্সিকোর গম উন্নয়ন কর্মসূচীর কর্ণধার ডক্টর নরম্যান আর্নেস্ট বোরলগের উদ্যোগে 1951 খ্রিস্টাব্দে উচ্চফলনশীল গমের বীজ উদ্ভাবনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়। ভারতে এই বীজ প্রথম ব্যবহৃত হয় 1964 থেকে 1965 খ্রিস্টাব্দে।
উপকরণ:
কৃষি ক্ষেত্রে যেসব নতুন কৌশল প্রয়োগ করে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়, সেই সব উপাদানকে সবুজ বিপ্লবের স্তম্ভ বা উপকরণ বলে। মোট 12 টি উপকরণ নির্দিষ্ট করা হয়েছে –
- উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার।
- জলসেচে সুযোগ বৃদ্ধি করা।
- রাসায়নিক সারের জোগান বাড়ানো।
- কীটনাশক ও পতঙ্গনাশক রাসায়নিকের জোগান বৃদ্ধি করা।
- প্রকল্প এলাকার উন্নয়ন বা কম্যান্ড এরিয়া ডেভেলপমেন্ট এর মাধ্যমে কৃষি পরিকাঠামোর উন্নতি করা।
- ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের জমি দেওয়া।
- ছোট জোতগুলিকে একত্রিত করে চাষের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- কৃষি ঋণ দেওয়া ও কৃষি ঋণ পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করা।
- গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া।
- বাজারগুলিকে গ্রামীণ সড়কের মাধ্যমে যুক্ত করা।
- কৃষি যন্ত্রপাতির জোগান বৃদ্ধি করা।
- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কৃষি গবেষণা ও কৃষি প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
সবুজ বিপ্লবের উদ্দেশ্য:
- বিভিন্ন কৃষিজ ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা।
- খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করা।
- কৃষিজ বর্ণের আমদানি বাবদ বৈদেশিক ঘাটতি হ্রাস করা।
- গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক ও ছদ্ম বেকারত্ব কমানো।
- অনাহার ও অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুহার হ্রাস করা।
- পতিত জমিকে কৃষিজমির আয়ত্তে আনা।
সবুজ বিপ্লবের সুফল বা সুবিধা:
a. মোট উৎপাদন বৃদ্ধি:
সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে ভারত গম ও ধানের উৎপাদন বহুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।গমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা নেয় ডক্টর নরম্যান বলরাম উদ্ভাবিত মেক্সিকো থেকে আনা উচ্চ ফলনশীল বীজ অন্যদিকে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ডক্টর এম এস স্বামীনাথন সর্ব অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন যেখানে ৮.২ কোটি টন ছিল সেখানে ২০১১ থেকে ১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ থেকে ৭৪ কোটি টন।
b. কৃষিজমির সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি:
সবুজ বিপ্লবের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেশে নতুন কৃষিপ্রযুক্তি এসেছে। ফলে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়েছে, যার ফলে কৃষি উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। গম, ধান, তুলো, আলুর চাষ লাভজনক হওয়ার কারণে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও বেড়েছে। কারণ সেচের সুযোগ বেড়ে যাওয়ার ফলে এক ফসলি জমে দু ফসলি জমিতে এবং দু ফসলি জমি বহু ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। তাই কৃষি শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে।
c. কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক পরিকাঠামোর ব্যবহার বৃদ্ধি:
সবুজ বিপ্লব হল আধুনিক পরিকাঠামো কেন্দ্রিক কৃষি বিপ্লব। সবুজ বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন হয় উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি, যেমন – হ্যান্ড টিলার, ট্রাক্টর, থ্র্যাসার প্রভৃতি উপাদানের। গত ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লব আসার ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে কৃষিকাজে উপাদানগুলির ব্যবহার লক্ষনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
d. খাদ্য সমস্যার সমাধান:
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতের জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে খাদ্যশস্যের সংকরট দেখা যায়। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সমস্যার সমাধান হয়েছে।
e. কৃষকের আয়বৃদ্ধি:
সবুজ বিপ্লবের জন্য বিক্রয় যোগ্য উদ্বৃত্ত ফসলের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে জমি থেকে উৎপাদন বাড়ায় কৃষকের আয়ও বাড়তে থাকে, তাই তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নে ঘটতে থাকে।
f. কৃষি ও শিল্পের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন:
কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে – 1. কৃষিভিত্তিক শিল্পের অগ্রগতি হয়েছে( যেমন – রাইস মিল, হুইট মিল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ইত্যাদি), 2. শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজাত পণ্য অধিক মাত্রায় ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে, 3. কৃষিকাজের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতির উৎপাদন বেড়েছে। 5. এছাড়া গ্রামাঞ্চলে মোটরবাইক, মপেড, টিভি, কম্পিউটার, স্মার্টফোন প্রভৃতির বিক্রি যথেষ্ট বেড়েছে।
g. খাদ্যশস্যের আমদানি হ্রাস:
সবুজ বিপ্লব ভারতকে ধান ও গম উৎপাদনে স্বনির্ভর করেছে। ফলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতকে যে প্রচুর পরিমাণে চাল, গম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো, সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে ভারত বিদেশে কৃষি পণ্য রপ্তানি করে।
সবুজ বিপ্লবের কুফল বা সমস্যা:
a. আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি:
সবুজ বিপ্লব ভারতের সর্বত্র সমানভাবে সাফল্য লাভ করেনি। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে সবুজ বিপ্লব যতখানি ফলপ্রসু হয়েছে অন্যত্র তা হয়নি।
b. শ্রেণীগত বৈষম্য বৃদ্ধি:
অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ধনী কৃষি সবুজ বিপ্লবের সুযোগ বেশি মাত্রায় গ্রহণ করে আরও বেশি সচ্ছল হয়েছে অন্যদিকে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি দিনে দিনে বেশি নিঃস্ব হয়েছে।
c. ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা:
কৃষিজ উৎপাদনে নতুন কৌশল পুঁজিবাদী খামার গড়ে তুলেছে। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় ১/৩ প্রান্তিক চাষী এবং 24.5% ক্ষুদ্র চাষি দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে।
d. অনিশ্চিত কর্মসংস্থান:
অনেকের মতে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।
e. দারিদ্র্যের প্রকোপ:
কোন কোন অর্থনীতিবিদের মতে আঞ্চলিক বৈষম্য এবং গ্রামাঞ্চলে মানুষের আয় গত বৈষম্য ঘটায় দারিদ্র্যের প্রকোপ বেড়েছে। অবশ্য অনেকের মতে উৎপাদন বাড়ায় খাদ্যশস্যের দাম কমেছে।