মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীবজগৎ, ভূপ্রকৃতি ও সময়ের ভূমিকা এখানে আলোচনা করা হল। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আশা করি এগুলি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। তোমরা নিজেরা মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং প্রশ্নগুলো তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।
মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীবজগতের ভূমিকা:
জীবজগতের প্রধান দুটি উপাদান হল – উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণীজগৎ। এরা উভয়ই মৃত্তিকা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
A. উদ্ভিদজগৎ:
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৃত্তিকার জৈব পদার্থের সংযোজন উদ্ভিদের আবরণীর উপর নির্ভর করে।
- উদ্ভিদের শিকড় শিলায় প্রবেশ করে এবং জল ও বাতাসের চলাচলের পথ সৃষ্টি করে দেয়।
- উদ্ভিদের মূল ও শিকড় মাটির নীচে যখন মরে যায় ও পচে যায়, তখন একাধিক জৈব অ্যাসিড নির্গত হয়। জীবন্ত শিকড় থেকে কার্বনিক অ্যাসিড ও অন্যান্য পদার্থ নির্গত হয়। অন্তঃপ্রবাহী জলধারার সঙ্গে এইসব অ্যাসিড ও অন্যান্য পদার্থ মিশে শিলা ও খনিজ পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে মৃত্তিকা গঠনে সাহায্য করে।
- জৈব পদার্থ ও হিউমাসের উপস্থিতি উদ্ভিদ আচ্ছাদনের প্রাধান্যের উপর নির্ভর করে।
- তৃণভূমি সমৃদ্ধ মাটির বর্ণ কালো হয়।
- উদ্ভিদের দেহাবশেষ বিবেচিত হয়ে খনিজ পদার্থ সৃষ্টি হয়। যেসব উদ্ভিদের পাতায় ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি ধাতব পদার্থ থাকে, সেসব পাতা পচে অম্লধর্মী মাটি গঠন করে। যেমন -পাইন বনাঞ্চলে মাটি অম্লধর্মী ও পডসল মৃত্তিকা হয়।
B. প্রাণীজগৎ:
জীবজন্তুর প্রভাব:
- মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ায় প্রাণীজগতের অবদান প্রধানত যান্ত্রিক প্রকৃতির। পিঁপড়ে, কেঁচো, ইঁদুর ইত্যাদি প্রাণী মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বিভিন্ন স্তরের উপাদানের মধ্যে মিশ্রণ ঘটায়, ফলে মাটি উর্বর হয়।
- জৈব পদার্থ বেশি থাকলে মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ বেশি হয় এবং মাটির রং কালো হয়। হিউমাস সমৃদ্ধ মাটির পুষ্টি মৌল সম্পন্ন হয়।
- তৃণাচ্ছাদিত অঞ্চলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি হয়। ফলে এখানের মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বেশি হয়।
জীবাণুর প্রভাব:
মাটির উৎপত্তি ও মাটিকে বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক চরিত্র প্রদানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবাণুর অবদান যথেষ্ট বেশি থাকে। জীবাণুর প্রকৃতি ও সংখ্যার উপর মাটির গঠন ও এর গুণাবলী নির্ভরশীল। যেমন –
- জৈব পদার্থের একমাত্র উৎস রূপে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ জীবাণুকূল বিবেচিত করে হিউমিফিকেশন প্রক্রিয়ায় হিউমাসে পরিণত করে।
- মাটির ওপরের স্তর বা নীচের স্তরে উদ্ভিদ কোশ বিয়োজনে ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকার জন্য উপর ও নীচের স্তরে মাটি উর্বর হয়, তথা নাইট্রোজেন আবদ্ধ হয়।
- উদ্ভিদের দেহাবশেষ জীবাণুর দ্বারা বিবেচিত হয়ে যে খনিজের সৃষ্টি করে তা মাটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মৃত্তিকা সৃষ্টিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব:
ভূমির উচ্চতা বন্ধুতা ভূমির ঢাল প্রভৃতিকে এক কথায় ভূপ্রকৃতি বলে, যা মৃত্তিকা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। যেমন –
- পার্বত্য ভূপ্রকৃতিতে মাটি গঠনে জনক শিলার প্রভাব বেশি। ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় চূর্ণীকৃত পদার্থ সহজেই অপসারিত হয় বলে মৃত্তিকার স্তর গঠন প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মৃত্তিকা অপরিণত বা নবীন অবস্থায় থাকে। এই ধরনের নবীন মৃত্তিকার সঙ্গে বড়ো বড়ো পাথর, শিলাখণ্ড, বোল্ডার ইত্যাদি মিশে যে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় তাকে কঙ্কালসার মৃত্তিকা বলে।
- উপত্যকার উচ্চ অংশ থেকে নিম্ন অংশ পর্যন্ত মৃত্তিকার পরিলেখের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।অর্থাৎ স্থানীয় ভূমিঢাল ও জলনিকাশি ব্যবস্থার পার্থক্যহেতু নির্দিষ্ট ভূ প্রাকৃতিক ঢাল বরাবর মাটিগুলি ভূপ্রকৃতির সঙ্গে নির্দিষ্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে শৃঙ্খলাকারে বিন্যস্ত হয়ে অবস্থান করে, একে মৃত্তিকার ক্যাটেনা বলে।
- পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু বিরাজ করায় নানা ধরনের মৃত্তিকা গঠিত হয়।
- খাড়া ঢাল যুক্ত ভূমিভাগে ক্ষয়কার্য বেশি এবং অনুস্রাবণ অপেক্ষা পৃষ্ঠপ্রবাহ বেশি হওয়ায় ভূমিভাগ উদ্ভিদহীন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মৃত্তিকা অগভীর হয় এবং বোল্ডার, নুড়ি, পাথর, কাঁকড়, বালি ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ থাকে।
- মৃদু ঢালু অঞ্চলে মাটির সুগভীর ও এর স্তর সুস্পষ্ট হয়। মাঝারি ঢালু অঞ্চলে মাটির গভীরতা মাঝারি। প্রবাহমান জলধারায় মাটি থেকে খনিজ জৈব পদার্থ অপসারিত হয়। মাটি বালি কাঁকর যুক্ত ও প্রবেশ্য হয়।
মৃত্তিকা সৃষ্টিতে সময়ের প্রভাব:
আবহবিকার গ্রস্ত শিলাচূর্ণ বা রেগোলিথ থেকে পরিণত মৃত্তিকা গঠন পর্যন্ত অতিক্রান্ত সময়কে মৃত্তিকা গঠনের সময় বলে। 1 ইঞ্চি স্তরের মৃত্তিকা গঠন হতে সময় লাগে কয়েক শত বছর।
প্রভাব:
- অপ্রবেশ্য পদার্থের চেয়ে বেলে পাথরের মত প্রবেশ ও পদার্থের মৃত্তিকা গঠন দ্রুত গতিতে সংঘটিত হয়। হিমাবাহ সঞ্চয়ের উপর মৃত্তিকা গঠিত হতে কয়েকশো বছর লেগে যায় এবং ভারী ব্যাসাল্ট এর উপর মৃত্তিকার গঠন হতে আরো অনেক বেশি সময় লাগে।
- মূল উপকরণ থেকে মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। 2-2.5 সেমি মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে কয়েকশো বছর লেগে যায়। মৃত্তিকা গঠনের জন্য যে দীর্ঘ সময় লাগে, তা নির্ভর করে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, ভূমিরূপ, আণুবীক্ষণিক জীব প্রভৃতি কতগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের উপর।
- অপরিণত মৃত্তিকাতে মূল উপাদানের চরিত্র প্রকট হয়। অপরিণত মৃত্তিকাতে স্তরায়ন সুস্পষ্ট নয়।
- কালক্রমে নবীন মৃত্তিকা পরিণত মৃত্তিকাতে রূপান্তরিত হয় এবং পরিণত মৃত্তিকা ক্ষয়ের কমলে পড়ে।
- মাটির দীর্ঘ সময় ধরে গঠিত হলে তা পরিণত অবস্থায় আসে। অনুকূল পরিবেশে মৃত্তিকা পরিণত অবস্থায় পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েকশো বছর। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে মৃত্তিকার পরিণত অবস্থায় পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েক হাজার বছর। পরিণত মৃত্তিকাতে স্তর সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা যায়।