জনসংখ্যা ও জনবসতি সম্পর্কিত কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলী এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আশা করি এগুলি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। তোমরা নিজেরা মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং প্রশ্নগুলো তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।
জনসংখ্যা সংক্রান্ত ম্যালথাস এর তত্ত্ব লেখ।
থমাস রবার্ট ম্যালথাস 1798 খ্রীষ্টাব্দে তাঁর ‘An essay on the principle of population mankind’ প্রবন্ধে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত population pessimism theory প্রকাশ করেন।
তত্ত্বের মূল বক্তব্য:
বেলথাস বলেন জনসংখ্যা ও খাদ্যের যোগান সময় নির্ভর ও বিপরীত ধর্মী। তার মতে সাধারণত খাদ্য দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় সমান্তরাল হারে, যেমন – 1, 2, 3, 4 ইত্যাদি কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর হারে, যেমন – 1, 2, 4, 8 ইত্যাদি এই ভাবে। ফলে প্রতি 25 বছর অন্তর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে এবং দেশে তীব্র দারিদ্রতা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্লেগ প্রভৃতি কারনে মৃত্যুহার ও বৃদ্ধি পাবে এবং জনসংখ্যার সামঞ্জস্যতা তৈরি হবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি:
ম্যালথাস এই ধরনের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির কথা বলেন –
a. প্রতিষেধক পদ্ধতি:
এই পদ্ধতিতে তিনি স্বামী স্ত্রী পরস্পরের নৈতিক আত্মসংযমের কথা বলেন।
b. অমোঘ পদ্ধতি:
দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বন্যা, ভূমিকম্প প্রভৃতি অঘোষিত কারনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পদ্ধতিকে অমোঘ পদ্ধতি বলে।
সমালোচনা:
- উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ ব্যতীত উন্নত দেশগুলিতে ম্যালথাসের তত্ত্ব অপ্রচলিত হবে।
- উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, প্রযুক্তি প্রভৃতি ব্যবহারে খাদ্যের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি করা যায়। কিন্তু ম্যালথাস তা বলেননি।
- জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে ম্যালথাস কিছু উল্লেখ করেননি।
উন্নত দেশগুলির জনসংখ্যা পিরামিডের প্রকৃতি আলোচনা কর।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির জনসংখ্যা পিরামিড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে জন্মহার কম হওয়ার জন্য শিশু ও কিশোর জনসংখ্যার চাপ কম এবং উপার্জনশীল মানুষের সংখ্যা বেশি। উন্নত দেশ গুলিতে বয়স লিঙ্গ পিরামিড আকৃতি অনুযায়ী তিন ধরনের হয়। যথা –
a. তৃতীয় শ্রেণীর মতো উত্তল ধরনের:
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে এই ধরনের পিরামিড দেখা যায়।
b. ঘন্টা বা বেল আকৃতির:
বহুদিন ধরে জন্ম হার ও মৃত্যুহার কম হওয়ার পরে হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করলে পিরামিড ঘন্টার আকার ধারণ করে। USA, কানাডার জন্মহার হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে আগত মানুষের বিশেষ ভূমিকা আছে।
c. নাশপাতির মত আকৃতি:
এখানে জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়ে কম, যেমন – জাপান, সুইডেন প্রভৃতি দেশের জনবিন্যাস।
প্রাত্যহিক যাতায়াত বা Commutation কাকে বলে?
যে আর্থসামাজিক পটভূমিকায় মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দৈনিক যাতায়াত করে তাকে প্রাত্যহিক যাতায়াত বা প্রাত্যহিক পরিব্রাজন বলে।
বৈশিষ্ট্য:
- এই পরিব্রাজন অবাধ অর্থাৎ কোনো আইনগত বাধা নেই।
- এর বিস্তার স্বল্প দূরত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
- উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দৈনিক পরিব্রাজনের অন্যতম উপাদান।
- কারখানার শ্রমিক ও চাকুরীজীবীদের অধিকাংশই দৈনিক পরিব্রাজনে অংশগ্রহণ করে।
যেমন – কলকাতা ও চারপাশের অঞ্চলে দৈনিক পরিব্রাজন লক্ষ্য করা যায়।
প্রবজনের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের কারণ কি?
যেকোনো ক্রোমোজোমের সাথে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ শক্তির সম্পর্ক গভীর। আকর্ষণ ও বিকর্ষণের কারণে পরিব্রাজন ঘটে।
আকর্ষণের কারণসমূহ:
- উচ্চতর শিক্ষালাভ ও গবেষণার সুযোগ।
- উপার্জনের অতিমাত্রায় সুযোগ।
- উন্নত সুযোগ-সুবিধা ভোগের ইচ্ছা।
- প্রবজনকারীর উপর নির্ভরশীল জনসংখ্যার সুযোগ।
- গন্তব্য দেশের অভিবাসন সম্পর্কে অনুকূল নীতি।
- নতুন অর্থনৈতিক কার্যাবলী (দুর্গাপুরের শিল্পাঞ্চল স্থাপিত হওয়ার পর মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।)।
বিকর্ষনের কারণসমূহ:
- স্বদেশে উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ।
- উচ্চতর আয়লাভের সুযোগের অভাব।
- বিদেশে নিরাপত্তার অভাব।
- বিদেশের শ্রম নিযুক্তির সুযোগ কম।
- দেশভাগ, যুদ্ধবিগ্রহ।
- জাতীয় সম্পদের ক্রমহ্রাসমানতা।
গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজনের কারণগুলি লেখ।
গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলের দিকে বিভিন্ন আর্থসামাজিক কাজে পরিব্রাজন সংঘটিত হয়। সাধারণত জীবিকার উদ্দেশ্যে বিশ্বের উন্নতিশীল দেশগুলিতে এই ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভারতের ক্ষেত্রে প্রায় ৬০% পরিব্রাজন এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজনের কারণ:
a. অর্থনৈতিক কারণ:
- প্রান্তিক কৃষি, ছদ্ম বেকারত্ব গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে পরিব্রাজনে সাহায্য করে।
- শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঋতুগত তারতম্য এবং ফসল কাটার পর সাময়িক কর্মহীনতা।
- গ্রামাঞ্চলে জীবিকা অর্জনের স্বল্প সুযোগ ও সম্ভাবনা গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজনে সাহায্য করে।
b. সামাজিক কারণ:
বিবাহ ও বিবাহের পর পারিবারিক অবস্থা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শহরমুখী পরিব্রাজন ঘটায়।
আন্তর্জাতিক বা অন্তর্দেশীয় পরিব্রাজন কাকে বলে?
যে অর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রভাবে জনসাধারণের কোনো একটি অংশ এক দেশ থেকে অন্য দেশে বা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা আশ্রয় নেবার উদ্দেশ্যে চলে যায়, তাকে আন্তর্জাতিক বা অন্তর্দেশীয় পরিব্রাজন বলে।
কারণ:
- দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা।
- উন্নতিশীল দেশগুলির দুর্বল অর্থনীতি ও পেশাগত সুযোগের অভাব।
- স্বচ্ছল জীবন যাপনের হাতছানি।
- দেশে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ না থাকা।
- দেশের সীমানা বদল।
- যুদ্ধ ও দাঙ্গা হাঙ্গামা।
- খনিজ সম্পদের নতুন ভান্ডার আবিষ্কার।
- শিক্ষাগত উৎকর্ষতার সুযোগ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কাকে বলে?
কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্মহার ও মৃত্যুহার এর পার্থক্যের শতকরা হারকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বলে।
জন বিস্ফোরণ কি?
স্বল্প সময়ে পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে যদি জনসংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায় তখন জনসংখ্যার অভাবনীয় বৃদ্ধিকে জনবিস্ফোরণ বলে।
প্রভাব:
- খাদ্য ঘাটতি দেখা যায়।
- অপুষ্টি, অশিক্ষা, অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।
- পরিবেশ দূষণ প্রকট হয়।
উদাহরণ – 1950 খ্রীষ্টাব্দে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় 248 কোটি, বিগত 60 বছরে তার বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় 712 কোটি (2011 সাল) সুতরাং জনবিস্ফোরণ ঘটেছে।
জনসংখ্যা পরিবর্তনে পরিব্রাজনের প্রভাব লেখ।
পরিব্রাজন জনসংখ্যার উপর যে সকল প্রভাব ফেলে তার নিম্নরূপ –
- জনসংখ্যার বয়স ও লিঙ্গ কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলে যা জনসংখ্যা পরিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক।
- উৎস অঞ্চলে মৃত্যুহার কমে জন্মহার বাড়ে, ফলে ওই অঞ্চলে জনসংখ্যার গড় বয়স বেড়ে যায়। অন্যদিকে গন্তব্য অঞ্চলে অভিবাসনের ফলে জন্মহার বেড়ে যায় ও মৃত্যুহার কমে যায়।
- অর্থনৈতিকভাবে উৎস অঞ্চল দুর্বল হয় এবং গন্তব্য অঞ্চল সবল হয়।
- কোন অঞ্চলের দক্ষ শ্রমিকের বহির্মুখী প্রবজন ঘটলে ওই অঞ্চলে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
- স্বল্প জনসংখ্যা বিশিষ্ট অঞ্চলে অন্তর্মুখী পরিব্রাজনের ফলে শ্রমের যোগান বাড়ে, কৃষি, খনিজ ও শিল্পক্ষেত্রে উন্নতি ঘটে।
- অধিক জনঘনত্ব বিশিষ্ট এইরূপ পরিব্রাজনের ফলে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি হয়, বাসস্থান, পানীয় জলের উপর অধিক চাপ পড়ে এবং তীব্র বেকার সমস্যা দেখা যায়।