ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত কাকে বলে, ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র এবং বিভিন্ন ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের নাম এই লেখাটিতে আলোচনা করা হল। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আশা করি এগুলি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। তোমরা নিজেরা মনোযোগ সহকারে পড়ো এবং প্রশ্নগুলো তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত:
নিরক্ষরেখার উভয়দিকে 5°-20° অক্ষাংশের মধ্যে সূর্য সারাবছর লম্বভাবে কিরণ দেওয়ায় কখনো কখনো কোনো স্থানে বায়ু হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হলে, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঠান্ডা ও ভারী বায়ু প্রবলবেগে কুন্ডলাকারে ওই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে এবং প্রবল ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়, একে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বলে। এই ঘূর্ণবাত অত্যন্ত প্রবল ও স্বল্পস্থায়ী।
বৈশিষ্ট্য:
- ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের বায়ুচাপের অধিক পার্থক্য অনুভূত হয়।
- ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতে প্রবল বৃষ্টি হয়। ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে সর্বত্র বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় সমান থাকে।
- মূলত গ্রীষ্মকালে সংঘটিত হয়।
- ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে উত্তাপের বিস্তার সর্বত্র সমান থাকে।
- ঝড়ের প্রবলতম অংশে বায়ুর বড়ো রকমের স্থানান্তর হয় না।
- বায়ুর গড় গতিবেগ ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বা তার বেশি হয়।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তির শর্ত:
1. ইন্দ্রিয়গ্ৰাহ্য তাপ ও লীনতাপ:
সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা 27° সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে যথেষ্ট পরিমাণ বাষ্পীভবন ঘটে। ফলে বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প মিশে যায়, যা প্রয়োজনীয় লীনতাপ প্রদান করে।
2. উষ্ণ জলের গভীরতা:
27° সেলসিয়াস উষ্ণতায় জলের গভীরতা অনধিক 60-70 মিটার হওয়া অবশ্যক হয়। তা না হলে গভীর পরিচালন স্রোতের জন্য নীচের শীতল জল উপরে উঠে এলে তাপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় ও ঘূর্ণবাত বিলীন হয়ে যায়।
3. বায়ুমণ্ডলের নীচু স্তরে ভূতপূর্ব গোলযোগের উপস্থিতি:
ITCZ -এ পুবালি বায়ুতরঙ্গের অবস্থান ঝড়ের প্রাথমিকভাবে বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।
4. ঊর্ধ্ব বায়ুমন্ডলে গোলযোগ:
ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে কোন নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের পরিত্যক্ত ট্রাফ থাকলে, তার কেন্দ্রে শীতল বাতাস থাকে। এই বাতাস প্রচুর লীন তাপ ত্যাগ করলে ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয়।
5. কোরিওলিস বল:
বাতাসকে তরঙ্গের মতো পরিচালিত করতে ন্যূনতম কোরিওলিস বল প্রতি সেকেন্ডে 10 to the power 5 ডাইন হওয়া বাঞ্ছনীয়। 5° অক্ষাংশে যে বল থাকে, তা ঘূর্ণবাতের ঘূর্ণির সূচনা করতে পারেনা। এই বল 5° অক্ষাংশের পর বৃদ্ধি পায়। এইজন্য অধিকাংশ ঝড় 15° অক্ষাংশ সংলগ্ন অঞ্চলে সংঘটিত হয়।
6. বাতাসের ন্যূনতম উলম্ব উত্থান:
বাতাসকে একটি ন্যূনতম উচ্চতায় উঠতে হয়, যেখানে ঘনীভবনের ফলে উৎপন্ন লীনতাপ ঘূর্ণবাতের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিতে পারে। এছাড়া বাতাস উর্ধ্বগামী হলে অন্তঃপ্রবাহ বজায় থাকে ও চিমনি গঠনের মাধ্যমে ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটায়।
7. অধিক আর্দ্রতা:
ট্রপোস্ফিয়ারের মধ্যাংশে 60% এর বেশি আর্দ্রতা ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির পক্ষে আদর্শ।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র:
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
1. প্রারম্ভিক পর্যায়:
এই পর্যায়ে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে সমুদ্রের উপর পরিবর্তনশীল বাতাস এলোমেলোভাবে প্রবাহিত হয় এবং বজ্রবিদ্যুৎ সহ ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটায়। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বায়ুর চাপ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। বাতাস ক্রমাগত আবর্তিত হয়ে একটি ঘূর্ণি সৃষ্টি করে ও অবশেষে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়।
2. বিকাশশীল পর্যায়:
এই পর্যায়ে বায়ুর চাপ ক্রমশ কমতে থাকে, বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যায়। ঝড়ের চক্ষুকে কেন্দ্র করে বাতাস আবর্তিত হতে থাকে ও ঘূর্ণবাত অগ্রসর হতে থাকে। বিশাল অঞ্চল জুড়ে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায় ও মুষলধারে বৃষ্টি হয়। কোনো কোনো সময়ে ঘূর্ণবাত ভেঙে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে একটি ঘূর্ণবাত ক্রমশ বড়ো হয়ে বিধ্বংসী শক্তিশালী উন্নয়তের পরিণত হয়।
3. পরিণত পর্যায়:
এই পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় প্রবল আকার ধারণ করে। একে চারটি বৃত্তীয় বলয় ভাগ করা যায় –
- 10-20 km ব্যস যুক্ত কেন্দ্র অঞ্চল এই অংশে মৃদুমন্দ বাতাস বয় ও আকাশ পরিস্কার থাকে।
- এর পরবর্তী অংশে আছে বিক্ষুদ্ধ বলয়, যার ব্যাস 50-150 km। এই অংশে বায়ুর চাপঢাল খাড়া হয়, বাতাসের বেগ বেশি থাকে ও প্রবল বৃষ্টি হয়।
- বহিঃস্থ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বলয়ে বাতাস প্রবলতম বেগে প্রবাহিত হয়।
- সর্ববহিঃস্থ বলয়ে দুর্বল ঘূর্ণিবায়ু প্রবাহিত হয়।
4. সমাপ্ত পর্যায়:
শক্তিশালী ঘূর্ণবাত স্থলভাগে প্রবেশ করার পর স্তিমিত হয়ে আসে। ভূপৃষ্ঠে ঘর্ষণজনিত বাধা ও সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্পের সরবরাহজনিত ঘাটতির ফলে ঘূর্ণবাতের শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসে। দু এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়। বায়ুপ্রবাহ দুর্বল হতে থাকে ও কেন্দ্রের নিম্নচাপ ক্রমাগত উচ্চচাপে পরিণত হয় ও অবশেষে ঘূর্ণবাতের বিনাশ ঘটে।
বিভিন্ন ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের নাম:
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন –
পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ক্যারিবিয়ান সাগরে – হ্যারিকেন।
চীন ও জাপান উপকূলে – টাইফুন।
বঙ্গোপসাগরে – সাইক্লোন।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশে – টর্নেডো।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে – কালবৈশাখী।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় – উইলি উইলি।